কলকাতা: সদ্য শেষ হয়েছে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। আর বাংলার ফল ঘোষণার পর থেকে প্রকাশ্যে আসছে রাজনৈতিক হিংসার অজস্র খবর। শাসক ও বিরোধী, দুই শিবিরের চাপানউতোর তুঙ্গে।
অথচ প্রবল রাজনৈতিক দ্বৈরথের মধ্যেও সৌজন্যের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন দুই 'প্রতিপক্ষ'। একজন বলছেন, প্রয়োজনে অন্যের এলাকায় গিয়ে উন্নয়নের কাজে হাত লাগাতে প্রস্তুত। অপরজন বলছেন, প্রতীক আলাদা হলেও দু'জনের লক্ষ্য়ই তো মানুষের জন্য কাজ করা।
মনোজ তিওয়ারি আর অশোক দিন্দা। প্রথমজন হাওড়ার শিবপুরের তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক। দ্বিতীয়জন পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক। দুজনের আর একটা পরিচয় হল, ক্রিকেট মাঠের দীর্ঘদিনের সতীর্থ। দুজনই জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। একসঙ্গে আইপিএলে খেলেছেন। বাংলার জার্সিতে বহু স্মরণীয় ম্যাচ রয়েছে সহযোদ্ধা হিসাবে। মনোজ যখন বাংলার অধিনায়ক, প্রতিপক্ষ শিবিরে ধাক্কা দেওয়ার জন্য সব সময় বল তুলে দিয়েছেন দিন্দার হাতেই।
ময়দানে দুজনকে হরিহর আত্মা বলা হয়। হবে নাই বা কেন? দুজনেরই উত্থান জেলা থেকে। একজন মেদিনীপুর। অন্যজন হাওড়া। বাংলার হয়ে একসঙ্গে বহু ম্যাচ খেলেছেন। জিতিয়েছেন। জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে একসঙ্গে কাটিয়েছেন। আইপিএলেও ছিলেন সহযোদ্ধা। এক ক্লাবের হয়ে স্থানীয় ক্রিকেট খেলেছেন। একই আবাসনে থাকেন। চাকরি পর্যন্ত করেন একই অফিসে। পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা? তাও একসঙ্গে। কখনও বেরিয়ে পড়ছেন ইউরোপ সফরে, কখনও অন্যত্র। মাঝে একবার দুজনের মধ্যে মতান্তর হয়েছিল বলে শোনা যায়। তবে এখন ফের সুসম্পর্ক। দুজনের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট খুলুন। একে অন্যকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, বিবাহবার্ষিকীতে অভিনন্দন দিচ্ছেন। একসঙ্গে ছবি পোস্ট করছেন।
সেই মনোজ আর দিন্দা রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষ। ভোটে হয়তো সম্মুখসমর হয়নি। কিন্তু যুযুধান দুই শিবিরের দুই মুখ দুজনে। যদিও রাজনৈতিক পরিচয় তাঁদের বন্ধুত্বে প্রভাব ফেলছে না। এমনকী, রাজনীতির ময়দানেও একে অপরকে সাহায্য করতে প্রস্তুত দুজনই।
আপনি জিতেছেন। দিন্দাও জিতেছেন ময়না থেকে। শুভেচ্ছা বিনিময় হল? এবিপি লাইভকে মনোজ বলছেন, "এখনও সময় পেয়ে উঠিনি। জেতার পর এত মেসেজ এসেছে যে, এখনও সকলকে রিপ্লাই করতে পারিনি। তার ওপর করোনা পরিস্থিতিতে কাজে নেমে পড়তে হয়েছে।" যোগ করছেন, "মানুষ ওকে জিতিয়ে নিয়ে এসেছে। আমাদের সকলেরই কাজ মানুষের পাশে সব সময় দাঁড়ানো। আশা করছি ও-ও দাঁড়াবে। সকলেই পরিশ্রম করছি।"
দিন্দার এলাকায় কোনও প্রয়োজনে আপনার সাহায্য চাইলে? "আমি সব সময় পাশে আছি। ওকে সাহায্য করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মানুষের কাজই তো করব দুজনে," এক নিঃশ্বাসে বলে দিচ্ছেন বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক।
দিন্দার গলাতেও এক সুর। তিনি ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণার দিন সবচেয়ে আবেগপূর্ণ বার্তাটা দিয়েছিলেন সম্ভবত মনোজই। ট্যুইট করেছিলেন, ‘অবিশ্বাস্য কেরিয়ারের জন্য অভিনন্দন। বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা পেসার। যে যোগ্য মর্যাদা পায়নি।’ রাজনীতির ময়দানে দীর্ঘদিনের সতীর্থ, বন্ধু মনোজ তিওয়ারি তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে জিতে বিধায়ক হয়েছেন। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে? দিন্দা বলছেন, "এখন দুজনই খুব ব্যস্ত। তাই ফোন বা মেসেজ করে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারিনি। আপনাদের মাধ্যমনেই মনোজকে শুভেচ্ছা জানাই।"
মনোজ তো প্রতিপক্ষ শিবিরের মুখ। যে শিবিরের বিরুদ্ধে ভোটের ময়দানে এত লড়াই করলেন! দিন্দা হাসতে হাসতে বলছেন, "রাজনৈতিক পরিচয় আমাদের বন্ধুত্বে চিড় ধরাবে না। এতদিন ধরে একসঙ্গে খেলেছি। কত ম্যাচ জিতিয়েছি। ওই সম্পর্ক কোনওদিন ভাঙতে পারে না। দলের হয়তো একটা অবস্থান থাকে। তবে সবাই চাইবে নিজের নিজের এলাকার উন্নতি করতে। সবাই সবাইকে সাহায্য করবে, এটাই প্রত্যাশিত। আমাদের দল আলাদা, প্রতীক আলাদা। তবে অশোক দিন্দা ও মনোজ তিওয়ারির লক্ষ্য় এক। আর সেটা হল মানুষের হয়ে কাজ করা। আমাদের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই।"
সৌজন্যের দৃষ্টান্ত তৈরি করছেন দুই ক্রিকেটার 'বিধায়ক'।