কলকাতা: তৃণমূল থেকে বিজেপি গিয়েছিলেন ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে। তার তিন বছর দু'মাস পর আবার পুরনো দলে ফিরেছিলেন ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহ। ২০২২ সালের ২২ মে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে এবং অধুনা প্রতিদ্বন্দ্বী পার্থ ভৌমিকে পৌরহিত্যেই উপস্থিতিতে পুনরায় জোড়াফুল পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের (Lok Sabha Elections 2024) ঠিক আগে আবারও পদ্মশিবিরে ফেরার কথা জানিয়ে দিলেন অর্জুন। এবার 'ঘরওয়াপসি'তে সময় নিলেন ২২ মাস। তৃণমূল থেকে কিছু 'বড় মাথা'কে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি-তে ফেরার কথা জানালেন অর্জুন। (Arjun Singh Timeline)
বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফেরার সময় অর্জুনের বক্তব্য ছিল, "বিজেপি তাঁকে রাখতে পারছে না।" আর এখন অর্জুনের বক্তব্য, "বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফেরা ভুল হয়েছিল। বিজেপি-র সেবা করব। তাতে যা হয় হবে। তৃণমূলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই আর।" আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী না করাতেই যে আবারও বিজেপি-তে ফেরার সিদ্ধান্ত, সেকথাও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন অর্জুন। জানিয়েছেন, তাঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে তৃণমূল।
সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাসী অর্জুনের অকপট স্বীকারোক্তি, সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাস করেন তিনি। ৪ সংখ্যাটি তাঁর জীবনে 'লাকি'। বাড়িতে, অফিসে ৪ সংখ্যার উপস্থিতিও সেই বিশ্বাস থেকেই। ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন অর্জুন, যোগ ছিল ৪ সংখ্যার। ২০২৪ সালে আবারও ১৪ মার্চই বিজেপি-তে ফেরার ঘোষণা করলেন। আজই তিনি বিজেপি-তে যোগ দিতে পারেন। কিন্তু 'লাকি' নম্বর এবারও সহায় হবে কি? আশা ছাড়ছেন না অর্জুন।
২০১৯ সালে বিজেপি-তে যোগদানের মুহূর্ত।
অর্জুনকে ফেরত নেওয়া নিয়ে মতভেদ রয়েছে রাজ্য বিজেপি-তে। তবে রাজ্য বিজেপি-র মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, "অর্জুন সিংহ আমাদের দলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমাদের দলে থেকে লড়াই করেছিলেন। বিজেপি-তে আসার পরও অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। আক্রান্ত হয়ে, রক্তাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ১০৭টি মামলা ঝুলছিল মাথার উপর। গদ্দার, অপরাধী বলে সম্বোধন করা হতো। তার পর আবার তৃণমূলে চলে গিয়েছিলেন। পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় তিনি তৃণমূলে গিয়েছিলেন বলে সকলেই জানেন। এখন আবার বলছেন বিজেপি-তে ফিরবেন। অনেকেই দলে আসতে চান। দল কাদের নেবে সেটা একটা বিষয়।"
বার বার এই দলবদলে অর্জুনকে কটাক্ষের শিকারও হতে হচ্ছে। তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই বলে মনে করছেন তাঁর অনুরাগীরা। কারণ ২২ মাস আগে, তৃণমূলে ফিরলেও, আগের মতো তাঁর সেই প্রতাপ এবং প্রভাব, কোনওটিই লক্ষ্য করা যায়নি। বরং জগদ্দলের তৃণমূলের বিধায়ক সোমনাথ শ্যামের সঙ্গে সংঘাত চরমে ওঠে। ভিকি যাদব খুনের ঘটনায় অর্জুন এবং তাঁর পরিবারের নাম উঠে আসে, যা নিয়ে সরব হয়েছিলেন সোমনাথই। অর্জুন ফের বিজেপি-তে ফেরার কথা জানাতে সোমনাথের প্রতিক্রিয়া, "তৃণমূলের অর্জুনের চ্যাপ্টার ক্লোজড।"
তবে সোমনাথে সঙ্গে সংঘাতের জন্য যে অর্জুন তৃণমূল ছেড়ে আবারও বিজেপি-র দিকে ঝুঁকছেন না, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ সংঘাত, টানাপোড়েন মাথায় নিয়েই ১০ মার্চ কলকাতার ব্রিগেডে তৃণমূলের 'জনগর্জন' সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন অর্জুন। সমাবেশ চলাকালীন বেশ খোশ মেজাজেই দেখা যায় তাঁকে। কিন্তু অভিষেক একে একে ৪২ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করতে শুরু করলেই কালো ছায়া নেমে আসে তাঁর মুখে। ব্যারাকপুরে পার্থকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। সমাবেশ শেষ হতেই সেই নিয়ে হতাশা উগরে দেন অর্জুন। তৃণমূল থেকে টিকিট পাচ্ছেন জেনেই সমাবেশে গিয়েছিলেন, কিন্তু দল তাঁকে নিরাশ করেছে বলে জানিয়ে দেন।
২০২২ সালে তৃণমূলে ফেরার মুহূর্ত।
এর পর গত কয়েক দিন ধরে লাগাতার দলের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিরাশা, হতাশার কথা সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরতে শোনা গিয়েছে অর্জুনকে। আগে জানলে তৃণমূলে ফিরতেন না বলে সমাবেশ থেকে ফিরেই মন্তব্য করেন তিনি। ১১ মার্চ আক্ষেপের সুরে বলেন, "বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে আসা ভুল হয়েছিল। আমাকে যোগ্য মনে করা হল না, ভুল হয়েইছিল। আমাকে ধোঁঁকা দেওয়া হয়েছে।" আবার বিজেপি-তে প্রত্যাবর্তনের কথা ভাবছেন বলেও জানান।
আক্ষেপের সুর এর পর বদলে যায় ক্ষোভে। ১২ মার্চ সংশোধিত নাগরিকত্ব নিয়ে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছেন, সেই সময় নেত্রীর বিরোধিতা করে অর্জুন বলেন, "CAA একটা নাগরিকত্ব, একটা সম্মান, তাঁদেরকে রিফিউজি বলে ডাকা হত। সেখান থেকে তো অনেকটা সম্মান। ৫০ বছরের লড়াই স্বীকৃতি পেয়েছে।এটা প্রধানমন্ত্রী মোদিজি করতে পেরেছেন। আমি তো তার পক্ষেই ভোট দিয়েছি! আমি মতুয়া ভাইদের পক্ষেই ভোট দিয়েছি। তাঁদের সম্মানেই ভোট দিয়েছি।"
অর্জুনের এমন মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তৃণমূলের শশী পাঁজা বলেন, "দল নীতি বলে দিয়েছে। আমরা সেটাই বলব। অন্য যে, যা বলছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত।" এর পর সুর নরম করার পরিবর্তে, চড়াতে শুরু করেন অর্জুন। ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে বিজেপি আরও ভাল ফল করবে, ব্যারাকপুরও বিজেপি-র দখলে থাকবে বলে জানান। নিজের দফতর থেকে মমতা এবং অভিষেকের ছবি সরিয়ে দেন তিনি। আবারও ফিরিয়ে আনেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবি। জানান, বিজেপি তাঁকে মন্ত্রিত্ব দিক বা না দিক, ব্যারাকপুরটা থাকলেই হল।
তৃণমূলের 'জনগর্জন' সভাতেই আশাভঙ্গ।
১৩ মার্চ সুর আরও চড়ান অর্জুন। ব্যারাকপুরে যাঁকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল, সেই পার্থকে সরাসরি নিশানা করেন। জানান, প্রার্থী তিনি ব্যারাকপুর থেকেই হবেন। পার্থর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করবেন। এর জবাবে পার্থ জানান, অর্জুন বিজেপি-তে গেলে যেতে পারেন। তাঁকে দল যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা পালন করবেন তিনি। চেয়ার ধরে রাখার কোনও মোহ নেই তাঁর।
তবে এই টানাপোড়েন চলাকালীন বুধবার একেবারে কড়া অবস্থান নিতে দেখা যায় তৃণমূলনেত্রী মমতাকে। টিকিট না পেয়ে অর্জুন যে অসন্তুষ্ট, সেকথা বললে, মমতা জবাব দেন, অর্জুন এখনও বিজেপি-র সাংসদ। পদ ছাড়েননি তিনি। ব্যারাকপুরে তৃণমূলে প্রার্থী পার্থই। পার্থ জিতে ফিরবেন বলে পূর্ণ আস্থা আছে তাঁর। মমতার এই মন্তব্য করার পরই কার্যত ফুঁসে ওঠেন অর্জুন। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, তিনি যদি বিজেপি-রই সাংসদ, তাহলে তৃণমূলের ব্রিগেডে কেন ডাকা হল তাঁকে? টিকিট দেবে বলে কথা দিয়েও, তৃণমূল প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর পরই বৃহস্পতিবার এবিপি আনন্দের মুখোমুখি হয়ে জানিয়ে দেন, বিজেপি-তে যোগ দিচ্ছেন তিনি। তৃণমূলের কিছু 'বড় মাথা'ও তাঁর সঙ্গে পদ্মে যোগ দিতে যাচ্ছেন। সব ঠিক থাকলে আজই দিল্লি রওনা দেবেন অর্জুন, শুক্রে বিজেপি-তে পুনরায় যোগ দেবেন।
আরও পড়ুন: Arjun Singh: বিজেপিতে ফিরছেন, ঘোষণা অর্জুন সিংহের