কৃষ্ণেন্দু অধিকারী ও পার্থপ্রতিম ঘোষ, কলকাতা: নন্দীগ্রামে গিয়ে আহত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল প্রার্থীর নিরাপত্তার দায়িত্ব কার? ভোটের মুখে এই ঘটনা ঘিরেই শুরু হয়েছে তৃণমূল আর নির্বাচন কমিশনের সংঘাত। কিন্তু এ নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
নন্দীগ্রামে ভোটপ্রচারে গিয়ে আহত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিছকই দুর্ঘটনা? না গভীর ষড়যন্ত্র? সেসব নিয়ে ভোটের মুখে স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। তবে তার থেকেও বড় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে তৃণমূল নেত্রীর এই দাবি ঘিরে। তাঁর দাবি, ‘কোনও লোকাল পুলিশ ছিল না। এসপিকেও দেখতে পাইনি৷’
এখনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তিনিই। পুলিশমন্ত্রীও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। অন্যদিকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচ রাজ্যের ভোট ঘোষণা করে দিয়েছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। আর তার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে চালু হয়ে গিয়েছে আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি। পুলিশ প্রশাসনের রাশ এখন রাজ্য সরকারের হাত থেকে চলে গিয়েছে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের হাতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব কার? এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দিকে আগেই আঙুল তুলেছে তৃণমূল। পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশন নিরাপত্তা দিতে পারেনি, এটা সবাই দেখেছে ৷
পাল্টা তৃণমূলকে আবার কড়া ভাষায় কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ কোনও রাজ্যেরই দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজকর্ম কমিশন নিজের হাতে নেয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদনসাপেক্ষে নিয়ে যেভাবে প্রশাসনিক কাজকর্ম চলে, তেমনই চলছে। নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের ইচ্ছেয় এসব হচ্ছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তার উত্তর দেওয়াটাও অসম্মানজনক।
কিন্তু কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? বর্তমানে দেশের চিফ ইলেকশন কমিশনার হলেন সুনীল আরোরা। অতীতে একই দায়িত্ব সামলেছেন, এস ওয়াই কুরেশি। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি ট্যুইট করে বলেছেন, নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর পুলিশের ওপর রাজ্য সরকারের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। রাজ্যের ডিজিপি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সকলেই নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য। যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থাকে তাঁদের বরখাস্ত অথবা বদলি করে নির্বাচন কমিশন । তাঁকে সমর্থন করেছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘যখন নির্বাচন ঘোষণা হয়, তখন প্রার্থীর নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব কমিশনের। আমার বাড়িতে চুরি হলে রাজ্য দেখবে। কিন্তু যখন মুখ্যমন্ত্রীর ওপর হামলা হয়, তখন সেটা ল অ্যান্ড অর্ডারের ইস্যু। সেটা এখন কমিশনের হাতে।’’
যদিও, অনেকের গলায় আবার ভিন্ন সুর। বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় জানান, ‘‘অবাধ নির্বাচনের দায়িত্ব কমিশনের। নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা আছে। ভারতীয় ৩২৯ ও ৩২৪ ধারায় বলা আছে অবাধ নির্বাচন করতে সম্পূর্ণ ক্ষমতা ইসি। এক্ষেত্রে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করা বাধ্যতামূলক নয়। একমাত্র ৩৫৬ ধারা জারি হলে আইনশৃঙ্খলা কেন্দ্রের হাতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা এখনও রাজ্যেরই হাতে। নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে নির্দেশ দেবে কমিশন। সেক্ষেত্রের সহমতের প্রয়োজন নেই। কে কী বলল সেটা প্রশ্ন নয়, সংবিধান কী বলছে সেটাই বড় কথা।’’
অতীতে একাধিক নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক জহর সরকারের। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়ালেও, কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। প্রাক্তন মুখ্যনির্বাচনী আধিকারিক জহর সরকার বলেন, ইসি যা বলছে তা ঠিক। কিন্তু চিঠিতে সৌজন্য সহানুভূতির অভাব প্রকট। একজন আধিকারিক আরেকজন আধিকারিককে বলছেন সেটা শোভনীয় নয়। এখনকার ইসি তো নিরপেক্ষ নন। তারা তো ব্যবহারযোগ্য। কমিশনারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে। এই অফিসার বদল আরও হবে। কিন্তু অডিও টেপ শোনা যায় যে একে ওকে বদল করলে সুবিধা, সেখানে অঙ্গুলি হেলনে বদল হলে প্রশ্ন উঠবে। সব মিলিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংঘাত শেষ হওয়ার লক্ষণ চোখে পড়ছে না।