উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়, রায়গঞ্জ: বলতেনই তিনি। আজ না হোক কাল বলতেই হত তাঁকে। গতবারও বলেছিলেন। তবে সেবার বলেছিলেন ভোটের মাত্র পনের দিন আগে। এবার বললেন ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই।


তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের সুপ্রিমো। সবাই জানেন তাঁকে ঘিরেই তৃণমূল কংগ্রেস। শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সদ্য দলত্যাগীরা কটাক্ষ করে 'দিদি ভাইপো'-র দল বলছেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক ১৫ দিন আগে এক জনসভায় দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে শোনা গিয়েছিল, '২৯৪ টি কেন্দ্রে প্রার্থী আমিই, আমাকে ভোট দিন। সব দায় এবং দায়িত্ব আমার।'


বুধবার রায়গঞ্জে জনসভায় দাঁড়িয়ে ঠিক একই কথা শোনা গেল তৃণমূলনেত্রীর গলায়। তাঁর বক্তব্য, 'এই ভোট আমার ভোট। আমাকে ভোট দিন। কারা প্রার্থী হবে সেটা আমি দেখছি। যারা টাকার লোভে দল ছেড়ে অন্য দলে চলে যাবে না, তাদেরই প্রার্থী করব।'


মমতার এই বক্তব্যের পরেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চর্চা। ভোটের দিনক্ষণ এখনও ঘোষণা হয়নি। কে প্রার্থী হবেন তা নিয়ে এখনও চলছে কাটাছেঁড়া। তাহলে কেন এত তাড়াতাড়ি সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন তিনি? প্রার্থীরা গৌণ, তিনিই যেন শেষ কথা।


রাজনৈতিক মহলের ধারণা, দিন যত যাচ্ছে তৃণমূলের ওপর চাপ ততই বাড়ছে। কারণ কী? 


এক, প্রথম পাঁচটা বছর ছিল মধুচন্দ্রিমা। বামেরা কিছু করেননি। দিদি তাও চেষ্টা করছেন। এই বলে ভোটের বৈতরণী পার হয়ে গেছিল। এবার কিন্তু সরকারের কাজের হিসেব-নিকেশ বুঝে নিতে চাইবে জনগণ। অর্থাৎ সরকার-বিরোধী যে হাওয়া তার মোকাবিলা করতে হবে তৃণমূলকে। 


দুই, একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ সামনে উঠে আসছে। টেট কেলেঙ্কারি, এতদিন যা ছিল শুধুমাত্র বিরোধীদের অভিযোগ, তার স্বীকারোক্তি মিলেছে সদ্য দলত্যাগী বিধায়কের মুখে। বন দফতরের নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ শোনা গেছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর গলায়। আমফানের টাকা নয়-ছয়ের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। ফলে 'সততার প্রতীক' এই হোডিং আর ভোটে ব্যবহার করা যাবে না। অস্বস্তি বাড়ছে তৃণমূল শিবিরে। 


তিন, দল ছেড়ে দুই মন্ত্রী, একাধিক বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, চোর, ধান্দাবাজ, মৌমাছি (মধু খায়), গরু চোর, যত রকমের আক্রমণ করা যায় সব শোনা যায় তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের গলায়। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন উঠছে, অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে সবই তো তারা তৃণমূলে থাকাকালীনই। তখন কেন ধরা হয়নি? আর এখন যাঁরা আছেন, ভবিষ্যতে তাঁদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? ভাবাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। 


চার, এখন যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে অন্য দলে যাচ্ছেন, তাঁদের বলা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে কংগ্রেস এবং সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন যারা, তাঁদের বীর সম্মানে হাতে দলীয় পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল। তাহলে তৃণমূলে এলে 'উন্নয়নের সঙ্গী' , আর তৃণমূল ছাড়লে 'বিশ্বাসঘাতক'। কোথাকার তথ্য? প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে দলকে।


পাঁচ, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ভাল ফল করার পর থেকেই বিধানসভা নির্বাচনের জন্য ঝাঁপাতে শুরু করেছিল। এখন সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের মতো নেতারা পশ্চিমবঙ্গের প্রায় "ডেইলি প্যাসেঞ্জার" হয়ে গেছেন। কেন্দ্রের অসংখ্য মন্ত্রী রোজ আসে, রোজ যায়। এরই মধ্যে তৃণমূল ভাঙছে। চাপ বাড়ছে দলের।


মুখ্যমন্ত্রীর সামনে এখন এতগুলো ফ্যাক্টর। ২০১১-য় ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছিল বামেরা। কিন্তু সেসময়ও বামেরা হারার আগে দল ছেড়ে কেউ পালিয়ে যাননি। লড়াইয়ে হারার পরে গেছেন। এক্ষেত্রে কিন্তু প্রবল প্রতাপ প্রতিপত্তি নিয়ে সরকারে থাকা অবস্থাতেই তৃণমূল ভাঙছে, এটা যে দলের কাছে কত বড় অস্বস্তি তা বিলক্ষণ জানেন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদরা।


দুটো গল্প খুব শোনা যায়। দুটোই ইঁদুরকে নিয়ে গল্প। ইঁদুর এক ঋষির কাছে এসে বলল, সুযোগ পেলেই তাকে বিড়াল খেয়ে ফেলে। ঋষি কি পারেনা তাকে বিড়াল করে দিতে? ঋষি বর দিয়ে তাকে বিড়াল করে দিলেন। এর কিছুদিন পরেই সেই বিড়াল ঋষির কাছে এসে বলল, আমাকে যেকোনও দিনই বাঘে খেয়ে ফেলতে পারে। ঋষি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বাঘ করে দিলেন। কিন্তু বাঘ হওয়ার পরই সে আক্রমণ করতে গেল ঋষিকে। ঋষি আবার মন্ত্র পড়ে সেই বাঘকে ইঁদুর বানিয়ে দিলেন।


দ্বিতীয় গল্পটা হল, মাঝ সমুদ্রে এক জাহাজ চলেছে। হঠাৎই ভয়ঙ্কর ঝড় উঠলো। জাহাজ প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা। হঠাৎ দেখা গেল জাহাজের মধ্যে থাকা ইঁদুরগুলো সব সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।


প্রথম গল্পটা রায়গঞ্জে সভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। শুভেন্দু, রাজীবরা কিভাবে ইঁদুর থেকে বাঘ হয়ে আবার কিভাবে ইঁদুরে পরিণত হয়েছেন তা বোঝাচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে দ্বিতীয় গল্পটি বলেননি। কারণ সেই গল্পে লেখা ছিল না শেষ পর্যন্ত জাহাজটি ডুবে গেছিলো, নাকি বন্দরে এসে ভিড়তে পেরেছিল।