জনপ্রিয়তার নিরিখে দেশের মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থান কোথায়? কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কি খুশি? এখনই দেশে লোকসভা ভোট হলে কে জিতবে বলে মনে করছে মানুষ? এমনই নানা বিষয়ে দেশবাসী কী ভাবছে, তার আভাস পেতে দেশের সমস্ত রাজ্যে ঘুরে ঘুরে সমীক্ষা চালিয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমীক্ষক সংস্থা সি ভোটার। দেশের ৫৪৩টি লোকসভা কেন্দ্রেই গিয়েছেন সমীক্ষকরা। খুঁটিয়ে কথা বলেছেন ৩০ হাজারের বেশি ভোটারের সঙ্গে। দীর্ঘ ১২ সপ্তাহ ধরে চলেছে এই সমীক্ষা।
এই সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের জনপ্রিয়তম মুখ্যমন্ত্রীদের তালিকায় মমতা সাত নম্বরে। একে রয়েছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক। তারপর অরবিন্দ কেজরিবাল, জগনমোহন রেড্ডি, পিনারাই বিজয়ন, উদ্ধব ঠাকরে, ভূপেশ বাঘেল প্রমুখ। কিন্তু, এই তালিকায় এক থেকে সাতে একজনও বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নেই। বিজেপি খাতা খুলেছে আট নম্বরে। তাও সদ্য দল ভাঙিয়ে কংগ্রেসের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া মধ্যপ্রদেশে। আর যে বাংলাকে গুজরাত বানানোর কথা বলছে বিজেপি, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জনপ্রিয়তার নিরিখে রয়েছেন দশ নম্বরে। দেশের প্রথম ১০ জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ৭ জনই বিজেপি বিরোধী দলের। দেশের সবচেয়ে কম জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ৭ জনই বিজেপি অথবা তার শরিক দলের।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মুখ্যমন্ত্রী পদে পছন্দ অধিকাংশ রাজ্যবাসীর। নানা ইস্যুতে গত ১০ বছরের তৃণমূল জমানায় রাজ্যবাসীর একাংশের মনে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। একাধিক দুর্নীতির ইস্যু, গণতন্ত্র হত্যার অভিযোগ তুলে লাগাতার শাসক দল, সরকারকে কোণঠাসা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে উঠে আসা বিজেপি। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ১৮টি আসন জিতে তারা এবার ২০২১ এর বিধানসভা ভোটে পালাবদল ঘটানোর স্বপ্ন দেখছে। এপ্রিলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট শেষ করে ফেলতে চাইছে নির্বাচন কমিশন। ভোট-যুদ্ধের দামামা প্রায় বেজেই গিয়েছে। অপেক্ষা এখন দিনক্ষণ ঘোষণার। এই পরিস্থিতিতে বাংলার মানুষ কী ভাবছে, তার আভাস পেতে সি-ভোটার সংস্থার চালানো জনমত সমীক্ষায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতার ভূমিকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই খুশি বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, নবান্নের মসনদে বসে মমতা যেভাবে রাজ্য সামলেছেন, তাতে তাঁর ওপর খুব সন্তুষ্ট ৪৩ শতাংশ। আংশিক সন্তুষ্ট ৩২ শতাংশ। দুটির যোগফল হয় ৭৫ শতাংশ। আবার আমফান ত্রাণ বন্টনে দুর্নীতি, সারদা-নারদা কেলেঙ্কারির মতো ইস্যুতে জনমানসে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে তাঁর পারফরম্যান্সে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সমীক্ষায় মতামত দেওয়া ২২ শতাংশ। ৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা কিছু বলতে পারছেন না এ ব্যাপারে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা সম্পর্কে রাজ্যবাসীর একেবারে স্পষ্ট মতামত রয়েছে এবং তা অনেকটা মমতার অনুকূলেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এখনও মমতার বিকল্প সম্ভবত তাঁরা কারও মধ্যেই খুঁজে পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপর বাংলার মানুষের কতটা ভরসা রয়েছে, তারও আভাস পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই সমীক্ষায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির ওপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট ৩৭ শতাংশ, আংশিক সন্তুষ্ট ৩৭ শতাংশ। দুটি যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশ। চূড়ান্ত অসন্তুষ্ট বলে মতামত জানিয়েছেন ২৪ শতাংশ। জানি না বলেছেন মাত্র ২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদির ওপর খুশি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।
২০১৬-র নভেম্বরে নোটবন্দির মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধীরা সরব হলেও দেশবাসী সাধারণ নির্বাচনে মোদির ওপরই আস্থা রেখেছেন। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে সন্ত্রাসবাদী শিবির গুঁড়িয়ে দেওয়া, বালাকোট বিমান হানার মতো পদক্ষেপ নিয়ে আমজনতার মধ্যে কয়েকগুণ জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছেন তিনি। এমনকী কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের প্রচারেও তিনিই ছিলেন বিজেপির প্রচারের মূল স্তম্ভ। তবে করোনাভাইরাস অতিমারী রুখতে জারি হওয়া লকডাউনের ধাক্কায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যখন বিপর্যস্ত হয়েছে, অর্থনীতি জোর ধাক্কা খেয়েছে, বহু মানুষ রুটি-রুজি হারিয়েছেন, সেই প্রেক্ষাপটে তাঁর ওপর কতটা ভরসা করছেন এ রাজ্যের মানুষ? সি ভোটার পরিচালিত জনমত সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী মোদির ভূমিকাকে কী চোখে দেখছেন রাজ্যবাসী, তার হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, এ রাজ্যেও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তিনি কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছেন। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চান ৬২ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গবাসী। রাহুলকে পছন্দ মাত্র ২৮ শতাংশের।
বর্তমানে দেশে প্রধানমন্ত্রী মোদির কোনও বিকল্প আছে কি, এই প্রশ্নেও জনমত তাঁর অনুকূলেও গিয়েছে। ৫০ শতাংশ বলেছেন, তাঁর কোনও বিকল্প নেই। বিকল্প আছে, এটা মনে করেন ৩৫ শতাংশ, ১৫ শতাংশের উত্তর, বলতে পারব না।
এমনকী ভবিষ্যতে কোনও বিরোধী নেতা প্রধানমন্ত্রী মোদিকে টক্কর দিতে পারেন, সেই প্রশ্নেও পরিষ্কার, মোদির বিকল্প হিসাবে কাউকেই বেশি নম্বর দিতে নারাজ দেশবাসী। রাহুল গাঁধী, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেউই নন। ২৬ শতাংশের মত, ভবিষ্যতে রাহুল টক্কর দিতে পারেন মোদিকে, কেজরিবাল, মমতা তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবেন, এমনটা মনে করেন যথাক্রমে ২২ ও ৮ শতাংশ। ৪৪ শতাংশের অভিমত, এই তিনজনের কেউই মোদিকে টক্কর দিতে যথেষ্ট নন।
শুধু তাই নয়, অধিকাংশ দেশবাসীই করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে মোদি সরকারের পদক্ষেপে খুশি বলে দেখা যাচ্ছে সমীক্ষায়। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পারফরম্যান্স কেমন? জানতে চাওয়া হলে ভাল বলেছেন ৫১ শতাংশ, খারাপ বলেছেন ৩২ শতাংশ, বলতে পারব না, জানিয়েছেন ১৭ শতাংশ।
কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জেরে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবমূর্তি কি ধাক্কা খেয়েছে, জানতে চাওয়া হলে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৫২ শতাংশ, ৩৪ শতাংশ বলেছেন ‘না’, ‘জানি না’ বলেছেন ১৪ শতাংশ।