কিসি কি মুসকুরাহঠো পে হো নিসার
কিসি কা দর্দ মিল সকে তো লে উধার
কিসি কে ওয়াস্তে হো তেরে দিল মে পেয়ার
জিনা ইসি কা নাম হ্যায়... 


অনেকেই বলিউডের 'ট্র্যাজেডি কিং' বলেন তাঁকে। কণ্ঠস্বর থেকে গায়কী, 'দর্দ অর্থাৎ বেদনা'-ই তাঁর গানের মূল ইউএসপি, এমনই মত সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের অনেকের। তবে একইসঙ্গে রোম্যান্টিক মুডের গানেও তিনি অসামান্য। বারংবার নিজের গানের মাধ্যমে আম-আদমির কথা বলেছেন তিনি। আর তাই প্রয়াণের ৪৭ বছর পরেও সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে অমলিন তিনি। আগামী ২৭ অগস্ট মুকেশ চাঁদ মাথুরের ৪৭তম প্রয়াণ দিবস। নাহ এমন রাশভারী নামে তাঁকে খুব কম লোকেই চেনেন। তিনি আমার, আপনার সকলের কাছে পরিচিত মুকেশ নামেই। হিন্দি গানের দুনিয়ায় কিশোর কুমার এবং মহম্মদ রফিকে নিয়ে তরজা, চর্চা চিরকালের। তবে তার মাঝেও সাধারণ মানুষের হৃদয়ে বরাবর জায়গা করে নিয়েছেন মুকেশ। তাঁর প্রয়াণের প্রায় পাঁচ দশক হতে চলেছে। অথচ আজও নিত্যদিনের ব্যস্ত জীবনশৈলীতে জর্জরিত অনেকেই কারণে-অকারণে গুনগুন করেন মুকেশের গান। কারও কণ্ঠে থাকে 'জিনা ইসি কা নাম হ্যায়', কেউ বা গেয়ে ওঠেন 'জিনা ইয়াহাঁ, মরনা ইয়াহাঁ, ইস কে সিওয়া জানা কাহাঁ'। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এবছরই ছিল মুকেশের জন্ম শতবার্ষিকী। 


দিল্লিওয়ালা বনে দিলওয়ালে 


১৯২৩ সালের ২২ জুলাই দিল্লিতে জন্ম মুকেশ চাঁদ মাথুর ওরফে মুকেশের। পরিবারের দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। বাবা জোরাওয়ার চাঁদ মাথুর পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। তবে 'রাজা কা বেটা রাজা' থুড়ি 'ইঞ্জিনিয়ারের পুত্র ইঞ্জিনিয়ার' হননি। মুকেশের বিশ্বজোড়া খ্যাতি তাঁর সুরের জাদুর জন্যই। বাড়িতে তাঁর দিদিকে গান শেখাতে আসতেন মাস্টারজি। তাঁর নজরেই পরে মুকেশের প্রতিভা। পাশের ঘর থেকে দিদির গানের তালিম দেখত ছোট্ট মুকেশ। এরপর দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে স্কুল ছাড়েন মুকেশ। এরপর কিছুদিন চাকরিও করেন। সেই সময়ে একইসঙ্গে চলছিল গানের রেকর্ডিং নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা। পরবর্তীকালে দিদির বিয়েতে গান গাওয়ার সময় এক আত্মীয়ের নজরে আসেন মুকেশ। সেই আত্মীয় মোতিলাল আবার ছিলেন অভিনেতা। এই মোতিলালের তত্ত্বাবধানেই শুরু হয় মুকেশের প্রথাগত গানের তালিম। ১৯৪১ সালে 'নির্দোষ' ছবির জন্য প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মুকেশ। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একের পর এক হিট গান, ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার, জগতজোড়া খ্যাতি-সম্মান সবই এসেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। গানের কেরিয়ারে 'স্যাড সং', 'রোম্যান্টিক হিটস' সবই দর্শকদের উপহার দিয়েছেন মুকেশ। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন প্রেমিক মানুষ। পাত্র হিন্দি ছবিতে গান গায় বলে বিয়েতে নারাজ ছিলেন প্রেমিকার বাবা। তাই পালিয়ে গিয়ে সরল ত্রিবেদীকে বিয়ে করেন মুকেশ চাঁদ মাথুর। সালটা ছিল ১৯৪৬। সেই সময়ে পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে, আত্মীয়-পরিজনের অনেকেই অসুখী দাম্পত্য এমনকি ডিভোর্সের কথাও চিন্তা করে ফেলেছিলেন। তবে শত্তুরের মুখে ঝামা ঘষে ৩০তম বিবাহবার্ষিকী ধুমধাম করে পালন করে ১৯৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্যুরে যান মুকেশ।


আমেরিকার মিউজিক্যাল ট্যুরেই প্রয়াত হন মুকেশ 


মিশিগানে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় জনপ্রিয় গায়কের। সেই সময় দেশে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তিনিও ছিলেন মুকেশের এই মিউজিক্যাল ট্যুরের সঙ্গী। কনসার্টে পারফর্ম করার দিন সকালেই মৃত্যু হয় মুকেশের। পরে সেই কনসার্টে গান গেয়েছিলেন লতাজি এবং মুকেশ পুত্র নিতিন মুকেশ। মৃত্যুর পরেও মুকেশের রেকর্ড করা বেশ কিছু গান পরবর্তে অনেক ছবিতে রিলিজ হয়েছে। এই তালিকায় 'অমর আকবর অ্যান্টনি', 'দরিন্দা', 'ধর্ম বীর', 'খেল খিলাড়ি কা' ও আরও কিছু সিনেমা রয়েছে। রাজ কাপুরের ভাই শশী কাপুরের লিপে 'সত্যম শিবম সুন্দরম' সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে মুকেশের গান 'চঞ্চল শীতল নির্মল কোমল'। শোনা যায়, মুকেশের কণ্ঠে গাওয়া গান শেষ রিলিজ হয়েছে ১৯৯৭ সালের ছবি 'চন্দ্র গ্রহণ'- এ। 


রাজ কাপুরের ছবি মানেই গান গাইবেন মুকেশ


৯০-এর দশকের ছেলেমেয়েরা শাহরুখ খান মানে অভিজিতের গান, আমির খান মানে উদিত নারায়ণের কণ্ঠ, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের ছবি মানে কুমার শানুর গান... এই যুগলবন্দিতে অভ্যস্ত। ঠিক তেমনই ছিল 'কাপুর সাহাবের' সিনেমা আর মুকেশের গান। আর এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে 'মেরা নাম জোকার' নিয়ে আলোচনা হবে না, তাই কখনও হয়। যেমন ছবি, তেমনই তার গান। লিরিক্স থেকে সুর, মুকেশের গায়কী, রাজ কাপুরের অভিনয়- এই সিনেমা বলিউডের ইতিহাসে আজীবন জ্বলজ্বল করবে। শুধু 'জিনা ইয়াহা মরনা ইয়াহা' নয়, রাজ কাপুরের ছবি 'আনাড়ি'- র গান 'জিনা ইসি কা নাম হ্যায়'- এর মাধ্যমেই সত্যিই সাধারণ মানুষকে রূঢ় বাস্তবের মধ্যেও বাঁচতে শিখিয়েছেন মুকেশ। এই তালিকায় রয়েছে আরও একাধিক গান। কবি শৈলেন্দ্রর লেখা অসংখ্য গান গেয়েছেন মুকেশ। তাঁর সঙ্গে হিট জুটি ছিল শঙ্কর-জয়কিষেণের। পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয় হয়েছিল মুকেশ এবং কল্যাণজি-আনন্দজির জুটিও। রাজ কাপুরের জন্য গান গেয়ে সেঞ্চুরি পার করেছেন মুকেশ। শোনা যায় মুকেশের মৃত্যুর খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন রাজ কাপুর, বলেছিলেন 'আমার কণ্ঠস্বর হারালাম'। 


'কভি কভি মেরে দিল মে'... রোম্যান্টিসিজম, যশ চোপড়া এবং অমিতাভ বচ্চন


১৯৭৬ সালে রিলিজ হওয়া ছবি 'কভি কভি'। আজও বলিউডের রোম্যান্টিক হিন্দি ছবির তালিকায় প্রথম সারিতেই থাকবে যশ রাজ ফিল্মসের এই সিনেমা। আর দর্শক চিরকাল মনে রাখবেন এই ছবির সব গান। তবে অমিতাভ বচ্চন এবং রাখি গুলজার অভিনীত এই ছবির দুটো গানকে আলাদাই মাত্রা দিয়েছেন গীতিকার-সুরকার সাহির লুধিয়ানভি এবং অতি অবশ্যই মুকেশ। যেমন গানের কথা, তেমনই সুর- 'কভি কভি মেরে দিল মে' হোক বা 'ম্যায় পল দো পল কা শায়র হু'... একুশ শতকেও প্রেম নিবেদনের জন্য এইসব গান জেন-ওয়াইয়ের অনেকের ক্ষেত্রেই পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। 


মুকেশের গান শুনে আবেগে ভাসেননি এমন লোক নেহাতই হাতেগোনা


'কহি দূর যব দিন ঢল যায়ে'... হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের সিনেমা 'আনন্দ', বড়পর্দায় একসঙ্গে অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, ক্যানসার আক্রান্তের চরিত্রে অভিনয় করছেন রাজেশ খান্না, তাঁর সংলাপ 'বাবুমশাই জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নেহি'... সিলভার স্ক্রিনে ভরপুর আবেগের মধ্যে এই সিনেমাকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল মুকেশের ভয়েস টেক্সচার, সলিল চৌধুরীর সুর এবং যোগেশের লেখা গান 'কহি দূর যব দিন ঢল যায়ে, সাঁঝ কি দুলহন বদন চুরায়ে, চুপকে সে আয়ে'। 


মুকেশ মানে কি শুধুই 'বেদনা'... প্রেমের গানেও সমান দক্ষ দিল্লির মুকেশ চাঁদ মাথুর


প্রিয় মানুষকে নিয়ে ডেটে যাবেন ভাবছেন? সঙ্গী যদি সঙ্গীতপ্রেমী হয়, তাহলে ডেটিং ভেনুর ব্যাকগ্রাউন্ডে সেট করুন মুকেশের গান... মনজয় করে নিতেই পারেন গানের মোহময় আবেশে। রাজ কাপুর, দিলীপ কুমার, সুনীল দত্ত, মনোজ কুমার, ফিরোজ খান- একাধিক সুপারস্টারের 'ভয়েস' হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন মুকেশ। আর সেইসব গান আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। নিজে গাইতে জানলে দু'কলি নয় গেয়েই দিন মনের মানুষের সামনে। আপনার কণ্ঠে থাকুক 'সাওয়ান কা মহিনা', 'সুহানা সফর অউর ইয়ে মৌসম হাসিন', 'ম্যায়নে তেরে লিয়ে হি', 'এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়' কিংবা 'ইয়ে মেরা দিওয়ানাপন হ্যায়'। 


মন ভাল রাখার দাওয়াই মুকেশের গান, আম-জনতার আশা-যন্ত্রণা, ক্ষণস্থায়ী জীবন-দর্শন, সবই উঠে এসেছে তাঁর গানে 


গান আমাদের সখ-দুঃখের সঙ্গী হতে পারে, মনখারাপ নিমেষে দূর করে, মন ভাল রাখতে পারে হালফিলে জনপ্রিয় হওয়া 'মিউজিক থেরাপি'। আর এর জন্য 'দাওয়াই' হিসেবে মুকেশের গান কিন্তু আপনি বেছে নিতেই পারেন। বর্ষার দুপুর হোক বা রাতের বৃষ্টি সঙ্গে যদি থাকে 'চন্দন সা বদন', 'এক দিন বিক জায়েগা মাটি কে মোল', 'মেরা জুতা হ্যায় জাপানি' কিংবা 'আওয়ারা হু'- এইসব গান, তাহলে মন ভাল থাকবে তো বটেই।


তথ্যসূত্র- গুগল, ইউটিউব