কলকাতা: করোনার প্রথম ঢেউয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। তখন শ্যুটিং চলছে পুরোদমে। প্রথমটা বুতেই পারেননি, কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। কোভিড পরবর্তী সময়ের আতঙ্ক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। তাই যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের বাড়বাড়ন্ত চারিদিকে, চারটি ছবির শ্যুটিং নিজেই স্থগিত করে দিয়েছেন অভিনেত্রী। পরিচালকদের ফেরত দিতে চেয়েছিলেন নগদ অর্থও। 'মুহূর্তের মধ্যে অবস্থার অবনতি ঘটছে.. চোখের সামনে প্রিয়জন মারা যাচ্ছে.. হ্যাঁ.. ভয় পাচ্ছি', বলছেন অপরাজিতা আঢ্য।
তখন 'চিনি'-র শ্যুটিং চলছে জোরকদমে। রোজ শ্যুটিং-এ যাচ্ছেন, কাজ করছেন অপরাজিতা। হঠাৎ একদিন বাড়ি ফেরার পথে অসুস্থ বোধ করলেন অপরাজিতা। বলছেন, 'পরেরদিন তিনটি লোকেসানে শ্যুটিং ছিল। ডান্স ফ্লোরে নাচের একটা দৃশ্য ছিল। চিত্রনাট্য অনুযায়ী নাচ করতে করতে আমি পড়ে যাব, মধুমিতা আমায় ধরবে। শ্যুটিং-এর সময় যতবার মধুমিতা আমার গায়ে হাত দিয়েছে, চমকে উঠে বলেছে, 'তোমার গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!' তারপর মম চিত্তে নাচের একটি দৃশ্য ছিল। গোটা নাচটার ২৫ বার টেক হয়। রাতে শ্যুটিং সেরে যখন ফিরছি, দেখি জ্বর ছেড়ে গিয়েছে। প্রথমটা বুঝতেই পারিনি কোভিড হয়েছে। এরপরও শ্যুটিং চলতে থাকে। জ্বর ছাড়লেও অন্য সমস্যা দেখা দেয়। সেটে ডায়লগ বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল। বাড়িতেও জ্বর হয় অনেকের। তখনই চিকিৎসক সন্দেহ করেন। তাঁর কথা মতো কোভিড টেস্ট করাতেই রিপোর্ট পজিটিভ আসে।'
করোনা পজিটিভ জানার পর সমস্ত নিয়মই মেনে চলেন অপরাজিতা। কিন্তু মানতে পারেননি করোনা পরবর্তী বিধি। চিকিৎসক বার বার বলেছিলেন, বিশ্রাম জরুরি। কথা না শুনেই কাজে যোগ দিয়েছিলেন অভিনেত্রী। অপরাজিতা বলছেন, 'অনেকগুলো কাজ পড়ে ছিল। কোভিড নেগেটিভ হয়েই ফিরি শ্য়ুটিং ফ্লোরে। কিন্তু বুঝতে পারতাম, ভিতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছি। হাঁটতে গেলে মাথা ঘুরত। ব্লাডপ্রেশার বেশি, কোনও ওষুধেই কাজ দিচ্ছিল না। আমি সাধারণত অল্পে কাতর হই না, কিন্তু কোভিড পরবর্তী সময়ের কষ্টই আমায় ভয় ধরিয়েছে। ওই সময়ের কষ্টটা কখনও ভুলব না। তাই এখন আরও অনেক বেশি সতর্ক।'
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বহু মানুষের মৃত্যু দেখেছেন অভিনেত্রী। দেখেছেন রেমডিসিভর, অক্সিজেন সিলিন্ডারের কালোবাজারিও। রোগের আতঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবিটাও কম ভয়ের নয়। অপরাজিতা বলছেন, 'যে মানুষ কিছুক্ষণ আগেও ভিডিও কলে কথা বলল, ৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেল। অক্সিজেন জোগাড় করতে গিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। কোথায় ৭০ হাজার টাকা অক্সিজেন সিলিন্ডার তো কোথাও ৫০ হাজার। রি-ফিল করার খরচ আলাদা। আমার ২৫ বছরের অভিনয়ে জীবনে কম চেনা পরিচিতি নেই। তাতেই অনেক সময় সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার প্রতিবেশীকে অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি। করোনা থেকে সেরে উঠেও মারা গেলেন। করোনা পরবর্তী ধকলটা অনেকেই সহ্য করতে পারছেন না। পর্যাপ্ত বিশ্রাম খুব জরুরি ওই সময়টায়। অনেকসময় চিকিৎসকরাও হাসপাতালে সিট পাচ্ছেন না। সাধারণ মানুষদের পরিণতি তখনই টের পেয়েছিলাম।'
পরিচালক পাভেলের সঙ্গে 'কলকাতা' আর 'মনখারাপ' এই দুটো ছবির শ্যুটিং করার কথা ছিল অপরাজিতার। হাতে আরও দুটি ছবি। রয়েছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের ছবি 'ফাটাফাটি' ও। তবে এখনই শ্যুটিং ফ্লোরে যেতে নারাজ অপরাজিতা। বলছেন, 'করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমার দেওরের কোভিড হয়েছিল। তারপরেই আমি সমস্ত শ্যুটিং আপাতত স্থগিত করার পরামর্শ নিই। যখন করোনার প্রকোপ কমেছিল তখনও শ্যুটিং করতে ফ্লোরে গিয়ে আমি সবাইকে সাবধান করেছি, মাস্ক-স্যানিজাইজার ব্যবহার করতে বলেছি। তবে তখন আরও ভয় করত। জানতাম, ৪৫ বছরের কম তাই টিকা পাব না। গত বুধবারই সবে ফার্স্ট ডোজ নিলাম আমি। এখন অনেকটা সাহস পেয়েছি। এবার ধীরে ধীরে কাজ শুরু করব ভাবছি।'
করোনা মানে শুধুই কী আতঙ্ক আর ভয়? না। আশার কথা বলছেন করোনাজয়ী অপরাজিতা। 'রাজ্যে লকডাউন ঘোষণার পর করোনার গ্রাফ তো ধীরে ধীরে নামছে। এতেই প্রমাণ হয়, সাবধান হলেই কোভিড এড়ানো যাবে।' বললেন অভিনেত্রী। তারপর যোগ করলেন, 'আমারও রাত্রে শুতে গিয়ে অনেক খারাপ চিন্তা মাথায় আসে। পরিস্থিতিটাই এমন। তবে যতটা পারেন নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। বাড়ির মধ্যে থেকেও পছন্দের কাজগুলো করুন। রান্না করুন.. গল্পের বই পড়ুন। এমন কাজ করুন যাতে মন ভালো থাকে। আর হ্যাঁ, যতটা সম্ভব বাড়ির বাইরে কম বেরোন। আর যদি বেরোতেই হয়, মাস্ক যেন নাকের নিচে না নামে। আর হ্যাঁ, সতর্ক থাকুন, তবে অযথা ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।'
রাজ্যে নামছে করোনার গ্রাফ। ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে লকডাউন বিধি। তবে শ্যুটিং ফ্লোরে ফেরা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে অভিনেতা অভিনেত্রী থেকে শুরু করে পরিচালক প্রযোজকদের মধ্যে। বাড়িতে বসেই সবাই দিন গুনছেন। অপেক্ষায় রয়েছে অপরাজিতা আর তাঁর 'কলকাতা', 'মনখারাপ' আর 'ফাটাফাটি'।