কলকাতা: কাশীর ঘোষাল বাড়ি থেকে ক্যালকাটা লজে ফিরে ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতেই চমকে উঠেছিলেন ফেলুদা ও তোপসে। আর লালমোহনবাবু? তাঁর চোখমুখের চেহারাই বদলে গিয়েছিল। অপার বিস্ময়ে চেয়েছিলেন আয়নার সামনে দাঁড়ানো অবয়বের দিকে।


তোয়ালে দিয়ে মাথা, গা-হাত-পা মুছছিলেন ঘরের চতুর্থ ব্যক্তি। হাতের প্রত্যেক নড়াচড়ায় যেন আন্দোলিত হচ্ছিল পেশি। কিছু পরেই জানা যাবে, পেশিবহুল শরীরের মালিক বিখ্যাত গুণময় বাগচি। বিশ্বশ্রী। লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়েছিলেন 'এদিকে চারশো, ওদিকে চারশো' পেশির নাম লিখতে।


কিংবদন্তি চলচিত্রনির্মাতা সত্যজিত রায়ের বিখ্যাত 'জয় বাবা ফেলুনাথ' সিনেমার এই একটি দৃশ্য রাতারাতি প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছিল মলয় রায়কে। মলয় রায়? চমকে উঠবেন না। সিনেমার গুণময় বাগচির প্রকৃত নাম মলয় রায়-ই। যদিও একটা ব্যাপারে রিল লাইফের সঙ্গে রিয়াল লাইফের শত ভাগ মিল। গুণময় বাগচির মতো মলয় রায়ও বিশ্বশ্রী।




এখন কেমন আছেন বিশ্বশ্রী? কী করছেন? 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-এর পর তাঁকে আর সিনেমায় দেখা গেল না কেন? সত্য়জিতের জন্মশতবর্ষে গুণময় বাগচির খোঁজ পেল এবিপি লাইভ। ডানলপ মোড়ে বডিফিট অ্যান্ড মাল্টিজিমে।


একটি আবাসনের তিনতলায় অবস্থিত জিমের দরজা খুলে ঢুকতেই দেখা গেল, শরীর চর্চায় ব্যস্ত কয়েকজন। আর তাঁদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এক সুঠাম চেহারা। কানঢাকা চুল। সত্যজিতের গুণময়। শরীরে বয়সের ভার দাঁত ফোটাতে পারেনি। শুধু চোখে চশমা ছাড়া বয়সের আর কোনও লক্ষণ নেই।


কত বয়স হল আপনার? রীতিমতো ডাম্বেল ভাঁজতে ভাঁজতে সুঠাম চেহারা বলে উঠল, '৭৪।' তাঁকে চাক্ষুস দেখার পর জবাব শুনে অবাক হয়ে যাবেন অনেকেই। ৭৪ বছর বয়সেও এত পেশিবহুল, শক্তিশালী, নির্মেদ চেহারা ধরে রাখা সম্ভব। যেন মুখ ফস্কে আপনা হতেই বেরিয়ে গেল, আপনার হাতের গুলি কি সত্যিই সতেরো ইঞ্চি? হাসতে হাসতে মলয় বললেন, 'সেভেন্টিন অ্যান্ড হাফ। ফিল করে দেখুন।' সত্যজিতের সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপ। তারপরই অবশ্য যোগ করলেন, 'এখন অবশ্য বয়স হয়েছে। বাইসেপসের আগের সেই মাপ নেই।'




চুয়াত্তরেও নিয়মিত শরীরচর্চা করেন। আর নিজের জিম চালান মলয়। করোনা কালেও তিনি সুপারফিট। মলয় বলছেন, 'প্রত্যেক দিন শরীরচর্চা করি। ব্রিদিং এক্সারসাইজ় করি। করোনা আমার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি।' তবে মাঝে একবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙেছিল। অস্ত্রোপচারও করাতে হয়েছিল।


সত্যজিতের সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ কীভাবে? মলয় বললেন, 'আমার বাবা বিশ্বশ্রী মনোতোষ রায়ের কাছে শরীরচর্চা করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিতবাবুর প্রিয় অভিনেতা ছিলেন সৌমিত্রদা। ওঁকে সত্যজিতবাবু সিনেমার জন্য পেশিবহুল চেহারার কারও খোঁজ দিতে বলেছিলেন। সৌমিত্রদা আমার নাম সুপারিশ করেন। আমাকে সত্যজিতবাবুর কাছে নিয়েও যান।'


কেমন ছিল সত্যজিত-দর্শনের প্রথম অভিজ্ঞতা? মলয় বলছেন, 'বইপত্তরের মধ্যে একটি আরাম কেদারায় আধশোয়া হয়েছিলেন সত্যজিতবাবু। আমি ওঁকে বলি, বাবা আপনাকে দাদা বলে। আমি কি জ্যেঠু বলতে পারি? উনি বলেন নিশ্চয়ই। ওঁর এক পুরস্কার। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো ওঁর বাড়িতে দেখতে পাব। কিন্তু সেটা না পাওয়ায় একটু হতাশ হই। জ্যেঠু বলেন, সে সব কি আর বাড়িতে রাখি! ব্যাঙ্কের লকারে থাকে। তার কয়েকদিন আগেই বিখ্যাত গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনেক পুরস্কার চুরি হয়ে গিয়েছিল।'


মলয় যোগ করলেন, 'সত্যজিৎ জ্যেঠু আমাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিতেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। খোলাখুলি বলেছিলাম, আমি কিন্তু কখনও অভিনয় করিনি। জ্যেঠু তো ছিলেনই, সৌমিত্রদাও বেশ অভয় দিয়েছিলেন। বাড়িতে ফেরার পর বাবাও বলেছিল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মহড়া দিস। ঠিক হয়ে যাবে।'


শ্যুটিংয়ে অবশ্য অসামান্য় অভিজ্ঞতা হয়েছিল মলয়ের। পর্দায় গুণময় বাগচির আবির্ভাবের পরই একটি বিখ্যাত দৃশ্য ছিল। সরল মনে কৌতূহলী জটায়ু বিশ্বশ্রীকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি ওজন তোলেন? গুণময় বলেছিলেন, না। তবে কাকে তুলতে হবে? বলেই পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপিয়ে এগিয়ে গিয়ছিলেন সন্তোষ দত্তের দিকে। তুলে কোলে করে ঘুরিয়ে বিছানায় ফেলেছিলেন।


সেই দৃশ্যের শ্যুটিংয়ের গল্প শোনালেন মলয়। বললেন, 'সিনেমায় কাশী লজের দৃশ্য হিসাবে দেখানো হলেও ওই অংশের শ্যুটিং হয়েছিল কলকাতায়। আমাকে সত্যজিৎ জ্যেঠু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কীভাবে সন্তোষদাকে তুলতে হবে। তবে আমি স্নায়ুর চাপে ভুগছিলাম। মানুষ তো ওভাবে কোনওদিন তুলিনি। সৌমিত্রদাকে বললাম, শ্যুটিং ফ্লোরের বেয়ারাদের চাগিয়ে প্র্যাক্টিস করে নেব? সৌমিত্রদা বললেন, যা না। সেই মতো অনুশীলন সেরে নিলাম বয়-দের চাগিয়েই। কিন্তু শ্যুটিং শুরু হওয়ার পর জ্যেঠু অ্যাকশন বলতেই সন্তোষদাকে চাগাতে গেলাম। আর ছটফট করে উঠলেন উনি। আমি নামিয়ে দিলাম। জেঠ্যু সন্তোষদাকে বললেন, ভয় পাবেন না। ওকে একটু তোলার সময় দিন। পরেরবার ফের একই কাণ্ড। সন্তোষদা এমন ছটফট করলেন যে, চাগাতেই পারলাম না। জ্যেঠু বললেন, মলয় একটা ব্রেক নাও। চা-জল খাও। ছোট্ট বিরতির পর ফের হল দৃশ্যের শ্যুটিং। আমি তখন মরিয়া। সদ্য দেহসৌষ্ঠব প্রতিযোগিতায় এশিয়ার সেরা হয়ে ফিরেছি। সন্তোষদাকে তুলতে না পারলে ইজ্জত নিয়ে টানাটানি হবে।'



অবশেষে এল সাফল্য। তৃতীয় টেকে। মলয় বললেন, 'আমি বদ্ধপরিকর ছিলাম। তৃতীয়বারের চেষ্টায় তুলবই। তুলেও ফেললাম। সন্তোষদা ছটফট করছিলেন। কিন্তু আমি ছাড়িনি। দৃশ্য শেষ করে নামাই। তারপরই টের পাই, আমার হাতের বুড়ো আঙুল মচকে গিয়েছে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল। আঙুল ফুলে গিয়েছিল। জ্যেঠু বরফের ব্যবস্থা করে দিলেন।'



জয় বাবা ফেলুনাথের পর তাঁর জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, রাস্তাঘাটে লোকে বাগচিদা বলে ডাকতেন। কিন্তু তারপর আর কোনও সিনেমায় দেখা গেল না কেন? মলয় বললেন, 'আমি কয়েকজন প্রযোজক-পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। কেউই সাড়া দেননি।'


চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর এখন তিনি জিম নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত। স্ত্রী প্রয়াত। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মলয়ের জীবন এখন সিনেমা থেকে অনেক দূরে। গুণময় বাগচি শুধু স্মৃতির একটি রঙিন অধ্যায় হয়েই থেকে গিয়েছে।