শুরুর কথা
হাওড়ার বিখ্যাত উকিল পরিবারের মেয়ে অপরাজিতার মা-বাবার বড় ইচ্ছে ছিল, মেয়ে শিল্পী হোক। হলও তাই। নাচে তুখোড় অপরাজিতা, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর পরিচালক শঙ্কর দাশগুপ্তের নাটকের দলে যোগ দিয়েছিলেন অপরাজিতা। সেখানেই অভিনেতা শঙ্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা ও তাঁর মাধ্যমেই টেলিভিশনের বিখ্যাত ধারাবাহিক মনোরমা কেবিনে কাজের সুযোগ পান তিনি। বৃষ্টিতে ডবডবে ভিজে অবস্থায় কোমর জল ভেঙে হাওড়া থেকে টালিগঞ্জে ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে পৌছেছিলেন আনকোরা মেয়েটি। বোঝেননি সেদিনই কাজের সুযোগ আসবে! 'আমার চারপাশে তখন মুনমুন সেন, অনুরাধা রায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী। কোনওদিন ভাবিনি এঁদের সঙ্গে কাজ করতে পারব!'বলছিলেন অপরাজিতা। সেই শুরু...
স্বামী টেকনিশিয়ান বলে কাজ চলে গিয়েছিল
'গেস্ট হাউস' বলে একটি টেলিফিল্মে কাজ করছিলাম। আমার স্বামী সেখানকার সাউন্ড ইঞ্জিনিয়র। পরিচয় হল। ওঁর মায়ের সঙ্গে দেখা হল একদিন। তারপরই ঠিক করে ফেললাম, এঁকেই বিয়ে করব। অভিনয় জীবন শুরুর একবছরের মাথায় বিয়ে করে ফেললাম। সক্কলের কপালে ভাঁজ। বেহালায় থেকে ভালভাবে কাজে মন দেব ভেবে বিয়ে করলাম, আর সব কাজ গেল চলে। কারণ,সবাই বলল, টেকনিশিয়ানকে বিয়ে করলি কেন!...প্রায় দুই বছর কোনও কাজ ছিল না। আর কেউ কোনওদিন অভিনয়ের জন্য ডাকবে, একপ্রকার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর একটি বিনোদন চ্যানেল লঞ্চ হতেই একের পর এক কাজের সুযোগ আসে। একসঙ্গে ৭ টা মেগাসিরিয়েলেও কাজ করেছি।...টেলিভিশনে সে এক স্বর্ণালী সময়। এক আকাশের নীচে, ইস্কাবনের বিবি, শিশিরের শব্দ, ফেরিঘাট...একসঙ্গে কত সিরিয়াল।
অবসাদ আর অপরাজিতা?
কোনওদিন কাজ না থাকায় অবসাদ আসেনি। কারণ আমি খুব পরিবার-কেন্দ্রিক মানুষ। বিয়ের পর যখন কোনও কাজ নেই, স্বামীর সঙ্গে দিব্য ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ করেছি। আর শ্বশুরবাড়ির আহ্লাদে থেকেছি। বরং ননদ বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমার কষ্টে অবসাদ আসে। রীতিমতো ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হতে হয়েছিল।
দুটো সিনে মুখ দেখাতে বম্বে যাব না
মুম্বইতে কাজ করব এমন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কোনওদিন বসে থাকিনি। বরং 'যশরাজ ফিল্মস' থেকে যখন ফোন আসে, তখন গয়না কিনছিলাম। কাস্টিং ডিরেক্টর শানো শর্মার ফোন ধরিনি। বলে দিয়েছিলাম, পরিচালক ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলব না। মিটিং করতে মুম্বই যেতে পারব না। অবশেষে পরিচালক অক্ষয় রয় নিজে ফোন করেন, বলেন 'মেরি পেয়ারি বিন্দু'তে অভিনয় না করলে বাড়ি এসে বসে থাকবেন। আমি তখন রাজি হয়ে যাই। ... 'বিন্দু' ছবিটাতেই দেখেছিলাম ৩৬-৩৭ টি সিনে শট দিয়ে ছবিতে রইল ১৬ টা সিন। তাহলে তার থেকে কম শটের ছবি করলে দেখা যাবে ছবিতে দুটি সিনে আমি রইলাম। অপরাজিতা আঢ্য তার জন্য বাংলা ছেড়ে বম্বে যাবে কেন?
কোনওদিন মাধুরী দীক্ষিত হতে চাইনি
আমি জানি আমি কে ও কী। আমার অভিনয়ের শক্তি সম্পর্কেও যেমন আত্মবিশ্বাসী, তেমন আমার সীমাবদ্ধতাটাও জানি। জানি আমি কী পোশাক পরব, কী পরব না। হিরোইনের তকমা পেতে তো চাইনি। 'ভাল অভিনেত্রী'র স্বীকৃতি চেয়েছি, পরিবারের সঙ্গ চেয়েছি। পেয়েওছি। যা পেয়েছি ২৪ বছরে, কোনও আফশোস থাকার কথা কি? রাজ্যের বাইরে গেলেও আমার কাজের প্রশংসা করেন সকলে। সেটাই তো প্রাপ্তি!
মোটা মনে হলে, রোল দিও না, ডেকো না
কোনওদিন জিমে গিয়ে কসরত করিনি রোগা হয়ে নায়িকা হব বলে। বরং 'প্রাক্তন'-এর সময় শিবু বলেছিল ৫ কেজি ওজন কমাতে। কিন্তু পাকেচক্রে ওজন কমাতে তো পারলামই না, উল্টে বোধ হল বেড়েই গেল কিছুটা। কাঁচুমাচু মুখ করে শিবুকে বললাম। তখন ও-ও বলল, ছাড়্ কী আর করা যাবে?... বডি শেমিংয়ের তোয়াক্কা করি না। বরং ওজন নিয়ে কথা বলতে এলে সোজা বলে দিই, রোল দিতে হবে না, রোগা হওয়ার চেষ্টায় আত্মগ্লানিতে মরব না। ইদানীং বরং নিজের শরীরের জন্যই বেশ কিছুটা ওজন ঝরিয়েছি। (বলেই হাহা করে হেসে উঠলেন অপরাজিতা)
তোর অভিনয় আমার থেকে ভাল হয়েছিল, তাই সিনটা রাখিনি, বলেছিলেন ঋতুদা
ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা সারাজীবনের সম্পদ। 'শুভ মহরত'- ছবিতে শুটিংয়ে যেতেও দেরি করেছিলাম। ঋতুদা তো হন্যে হয়ে বাড়িতে ফোন করছেন, রাগারাগি করছেন। সেটে পৌঁছতে রেগেমেগে বললেন, তুই ডবল ডেকার বাসের তলায় পড়ে মর্। তারপর ওঁর তত্ত্বাবধানেই ছোটপর্দাতে 'গানের ওপারে' করেছি। 'চিত্রাঙ্গদা' করেছি। সেখানে দুটো সিন ছিল। দেখলাম, একটা বাদ। খুব মন খারাপ হয়েছিল।
- ঋতুদাকে বলতে উনি বললেন, ওই সিনটায় তুই আমায় ছাপিয়ে গেছিস! তাই বাদ দিলাম। মানুষটা এভাবেই কথা বলত। তারপর আর কাজ করাই হল না।
ফেভারিটিজম তো দুনিয়ার নিয়ম
কোথায় নেই ফেভারিটিজম? আমি একটা ভাল কাজ করতে গেলে পছন্দের লোকেদেরই তো আগে অ্যাপ্রোচ করব। এটাই তো স্বাভাবিক। এতে বিতর্কের আছেটা কী! কিন্তু বাংলা অভিনয় জগতে পরিবারতন্ত্রের নিদর্শন কম। আমার মতো বেশিরভাগ মানুষই নন-ফিল্মি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন।
খুব সামান্য, তবু আমি অপরাজিতা
বম্বে থেকে অফার এসেছে, আসছে প্রচুর। কিন্তু পরিবার ছেড়ে থাকতে পারব না। একসময় তো এত ভাল অফার এসেছিল, আমার শাশুড়ি মাও সঙ্গে গিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। আমিই চাইনি। এই শহর, যৌথ পরিবার, স্বামী, আমার প্রাণ। এরই মধ্যে থেকে 'প্রাক্তন'-ছবিতে মলির মতো চরিত্র করেছি। 'জলনুপূর'-এর পারির মতো চরিত্র করেছি। ওয়েবসিরিজে 'বউমা ডিটেক্টিভ' করেছি। ২৪ বছর কাজ করার পর মনে হয়, আমি সামান্য হতেই পারি, কিন্তু অপরাজিতা।