কলকাতা: আলোর নীচে তখন ‘কার্তিকেয়’-তে মগ্ন উদয় শঙ্কর। আর দর্শকাসনে বসে বছর ১১-র কিশোরীর মনে হয়েছিল, মঞ্চে ‘ঈশ্বর’কে দেখছেন। সেই প্রেমের শুরু। তারপর নাচের তালিম, ডান্স গ্রুপের সঙ্গে দেশ বিদেশ ঘুরে অনুষ্ঠান। অবশেষে মাত্র ১৯ বছর বয়সে সাত পাক। আজন্ম তিনি বয়ে নিয়ে গিয়েছেন স্বামী উদয় শঙ্করের নৃত্যশৈলীকে। ১০১ বছর বয়সে ঘুমের মধ্যেই থেমে গেল সেই পথ চলা। প্রয়াত হলেন অমলা শঙ্কর। তাঁর খ্যাতি বিশ্ব জোড়া, কিন্তু নিজের পারিবারিক জীবনে তাঁর কোনও প্রভাব পড়তে দেননি অমলা। রান্না-বাটি খেলা থেকে রান্নাঘর, ছবি আঁকা থেকে গল্প বলা, সাবলীলভাবে পালন করেছেন সমস্ত ভূমিকা। তাঁর মৃত্যুর খবর প্রথম প্রকাশ্যে আনেন আনন্দ শঙ্কর ও তনুশ্রী শঙ্করের কন্যা শ্রীনন্দা শঙ্কর। মুম্বইতে থাকার দরুণ আসতে পারেননি শেষকৃত্যে। সেখান থেকেই এবিপি আনন্দের কাছে ‘ঠাম্মা’-র স্মৃতিচারণায় নাতনি শ্রীনন্দা।



নাচের প্রথম হাতেখড়ি অমলা শঙ্করের কাছেই। শ্রীনন্দা বলছেন, ‘৯০ বছর বয়সেও নাচ করার সামান্য সুযোগ ছাড়তেন না। আমি মায়ের কাছে নাচের নিয়মিত অভ্যাস করতাম, কিন্তু ঠাম্মা বিভিন্ন টিপস দিতেন। দাদুর সেই বিখ্যাত কার্তিকেয় আমায় শিখিয়েছিলেন তিনিই। পরবর্তীকালে আমি একাধিকবার তা মঞ্চস্থও করেছি। অনেক সময় আমাদের নাচ করে খাবারও খাইয়ে দিয়েছেন ঠাম্মা। এখনও মনে পড়ে, বিকেলবেলায় ভাত-আম মেখে ঠাম্মা খাইয়ে দিতেন আমাদের (শ্রীনন্দা, রাতুল ও রাজিত) সবাইকে। পৃথিবীর কাছে অমলা শঙ্কর তারকা নৃত্যশিল্পী, কিন্তু আমার কাছে উনি আমার ঠাম্মা!’





কেবল কি নাচ? পুরাণ থেকে শুরু করে কবিতা, ইতিহাস, তাঁর মুখে যে কোনও গল্পই আকর্ষণীয় লাগত শ্রীনন্দার। বললেন, ‘দাদুর অনেক গল্প করতেন ঠাম্মা। চাইতেন যে, আমরা তাঁর গল্পের মধ্যে দিয়েই তাঁকে চিনি। এ ছাড়া বিভিন্ন পুরাণের গল্প বলতেন। যে সব বই পড়তে আমাদের উৎসাহ হত না, সেগুলোকেই দারুণ সাজিয়ে আমাদের গল্প করে শোনাতেন।  বাংলা সাহিত্যের ওপর টান ছিল তাঁর। মুখস্থ ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব কবিতাই। কথার ছলে সেই সবই শোনাতেন আমাদের।’





শ্রীনন্দার সঙ্গে অমলার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। নাতনির সমস্ত মজার সঙ্গী যেমন ঠাকুমা, তেমনই আবার শ্রীনন্দার সোজাসুজি কথা বলার জন্য মাঝে মধ্যে ঝগড়াও হত দুজনের। নিজের বিয়ের স্মৃতি উস্কে শ্রীনন্দা বললেন, ‘আমার বরকে খুব পছন্দ করতেন ঠাম্মা। ভীষণ ভালোবাসতেন। আমায় বলতেন, তুই যদি বিয়ে না করিস আমি ওকে বিয়ে করে নেব। আমার বিয়েটা প্রাণভরে উপভোগ করেছিলেন।’  ছোটবেলা থেকেই খেলার সঙ্গী ছিলেন অমলা। শ্রীনন্দা বলেন, ‘ঠাম্মার আর আমার খেলনাবাটি ছিল। ছোট্ট স্টোভে কড়াই বসিয়ে আমার সঙ্গে মাছ রান্না করতেন।’



সেই সময়ের প্রায় সমস্ত কিংবদন্তির সঙ্গেই আলাপ ছিল অমলার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে নেতাজি, মহাত্মা গাঁধীর সংস্পর্শে এসেছিলেন একাধিকবার। জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে একটি বই লিখেছিলেন অমলা। তার মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন স্বয়ং নেতাজি। শ্রীনন্দার এখনও মনে পড়ে, ‘ তখন খুব ছোট ছিলাম। ঠাম্মা আমায় গল্প করে বলতেন, আমি যখন প্রথম ঘরে ঢুকলাম, দেখলাম কী সুন্দর দেখতে একজন দাঁড়িয়ে। নেতাজি ওয়াজ ভেরি ভেরি হ্যান্ডসাম।’



কেবল নৃত্য নয়, অমলা শঙ্কর নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন ছবি আঁকায়। রঙ তুলি নয়, আঁকার নতুন পদ্ধতি তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। শ্রীনন্দা বললেন,‘ ঠাম্মা নখ দিয়ে ছবি আঁকতেন। সেই সঙ্গে ব্যবহার করতেন তুলো, দেশলাই কাঠি, ঝাঁটার কাঠির মতো অদ্ভুত সব জিনিস। কোনও একটা দাগ কেটে দিলে সেটা দিয়েই একটা ছবি এঁকে ফেলতে পারতেন অনায়াসেই।’



‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’। প্রচলিত এই প্রবাদটি অনায়াসেই ব্যবহার করা যেত অমলা শঙ্করকে নিয়ে। উদয় শঙ্কর পরিচালিত ছবি ‘কল্পনা’য় উমার চরিত্রে অমলার নৃত্যাভিনয় দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিল। কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল ‘কল্পনা’। সেই সময় কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেওয়া কনিষ্ঠতম তারকা ছিলেন অমলা শঙ্কর। নাচ-ছবি আঁকায় পটু অমলার মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যেত রান্নাতেও। শ্রীনন্দা বলছেন,‘কন্টিনেন্টাল খেতে ভালোবাসতেন ঠাম্মা। রান্না করতে ভালোবাসতেন বিভিন্ন ইতালিয় খাবার। তাঁর হাতের স্প্যাগেটি আর মিটবল ছিল আমার আর বাবার (আনন্দ শঙ্কর) সবচেয়ে প্রিয়।’



জীবনে নিজের জন্য অবসর সময় প্রায় রাখেননি অমলা। সবটা কাটিয়ে দিতেন শঙ্কর ঘরানায় ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিতে। উদয় শঙ্করের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। শ্রীনন্দার ভাষায়, ‘অমলা-উদয় জুটি ছিল বটগাছের মতো। আমরা সবাই তারই শাখা-প্রশাখা।’



তিনি চাইতেন, তাঁর জন্য যেন কাউকে বিব্রত না হতে হয়। সেই ইচ্ছাপূরণ হবে বলেই হয়তো ২৪শে জুলাই সকালে আর ঘুম ভাঙল না অমলা শঙ্করের।