কলকাতা: ''আরে কেমন আছিস? আগের থেকে রোগা হয়েছিস কিন্তু। সেবার যা মোটা হয়েছিলিস! বাপ রে বাপ '। দেখা হলেই আমাদের গুটিকয়েক কথার মধ্যেই এসে পড়ে রোগা-মোটা প্রসঙ্গ। এই সমস্যা আজকের নয় চিরকালীন। ''


হাজারো কথা বলার বিষয় থাকলেও মানুষের কথাবার্তার শুরুতেই চলে আসে রোগা-মোটা, কালো-ফর্সা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। অনেকে সেটা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিলেও আপাতদৃষ্টিতে একটু স্থূল চেহারার মানুষরা নিছক মজা হিসেবে বিষয়টিকে দেখেন না। বরং মনে মনে কিছুটা দুঃখই পান। আর সেই সমস্যাটা তুলে ধরতেই 'ফাটাফাটি'।'' উইনডোজের আগামী ছবি নিয়ে বললেন, কাহিনিকার জিনিয়া সেন।
মহালয়াতেই আগামী ছবির নাম ঘোষণা ও পোস্টার প্রকাশ করেছে উইনডোজ প্রোডাকশন - 'ফাটাফাটি'। ছবিটির পোস্টারও অভিনব। একটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে প্লাস-সাইজ এক মডেলের ছবি। সেখানেই লুকিয়ে কাহিনির ভিত্তি। মোটা বলেই অসুন্দর নন, মডেলিং দুনিয়ায় অচল নন, সেই বার্তাই দিচ্ছে এই ছবি, জানিয়েছে টিম উইনডোজ। ছবির মুখ্য চরিত্রে অপরাজিতা আঢ্য।


এই সমস্যার শিকড় অনেক-অনেক গভীরে। মানুষের মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে রোগা-মোটা নিয়ে খুঁতখুঁতানি। এ ছবির নায়িকার বাস্তব জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়। রোগা-মোটা নিয়ে ব্যঙ্গের শিকার হতে হয়েছে অপরাজিতাকেও বরাবর। সেই অভিজ্ঞতার কথাই অভিনেত্রী ভাগ করে নিলেন 'এবিপি আনন্দ'র সঙ্গে।

মা দুর্গাকে কখনও দেখেছ স্লিম-ট্রিম?

এ বছর মহালয়ায় নতুন ছবির ঘোষণা করেছেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়। ছবির কাজ শুরুও হয়নি, কিন্তু আগমনীর আবহেই ছবির ঘোষণা। সেই প্রসঙ্গেই এসে পড়ে দুর্গাপুজোর কথা। অপরাজিতার প্রশ্ন, 'দেখেছ কখনও স্লিম-ট্রিম মা দুর্গা? আমাদের চোখে সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ রূপ তো তিনিই। অথচ বাস্তবে আমরা সব সময় একটু স্থূলকায় হলেই টিপ্পনী শুনি। মোটা চেহারা অথচ খোঁচা শুনতে হয়নি, এমন উদাহরণ বোধ হয় বিরল।'
অপরাজিতা জানালেন, 'একদিকে যেমন মোটা বলে ব্যাঙ্গ শুনেছি, তেমনই বহুবার তো দুর্গা হয়েছি, কত মানুষ বলেছেন তোমাকেই দুর্গা মানায়। তবে বলুন!'

কিশোরী বেলায় শুনেছি 'তালপাতার সেপাই', বড় হয়ে 'পাশবালিশ'

বরাবর তো তুমি মোটা নও....প্রশ্নটা শেষ করার আগেই অপরাজিতার জবাব, 'আরে না না। এত রোগা ছিলাম কম বয়সে দাদার বন্ধুরা বলত, তোর তো বিয়ে হবে না। বর জড়িয়ে ধরতে গেলে হাড়ে খোঁচা খাবে। জীবনে ফার্স্ট ক্রাশ। সে জানতে পেরে বলল...বাব্বা নমস্কার...ও তো তালপাতার সেপাই'। আর কেরিয়ার যখন মধ্য গগনে, ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেছেন, 'কী সব ব্লাউজ পরিস, পাশবালিশ মনে হচ্ছে!'
'তোর বউকে দেখে গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছে'

তাঁর একাধিক ছবিতে কাজ করেছেন অপরাজিতা আঢ্য। অথচ ইন্ডাস্ট্রির সেই কিংবদন্তী পরিচালকই অভিনেত্রীর স্বামীকে বলেছিলেন, 'অতনু, তোর বউকে দেখে গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছে'। ঋতুপর্ণ ঘোষ । 'মানুষটা এভাবেই কথা বলতেন', বললেন অপরাজিতা। 'শুধু উনি কেন, ইন্ডাস্ট্রিতে কে বলেনি আমায়! বিয়ের পর নানা কারণে ওজন বাড়ল যখন, তখন তো শ্যুটিং ফ্লোরে আমার নামই হয়ে গেল আপ্পু। রিয়্যালিটি শো-এ এই মোটা নিয়েই নানারকম প্র্যাঙ্ক করা হত। মীরাক্কেলে আমার মোটা শরীর নিয়েই নানারকম জোকস ক্র্যাক করা হত। যতই অভিনেত্রী হই, খারাপ লাগবে না? কেউ যখন বলত, তুই একটু রোগা হ, একটা ভাল রোল ভেবেছি। বলে দিতাম, 'রোল ভাবলে এই চেহারা নিয়েই ভাবো।
হয়ত দুর্মুখ নই বলেই, মানুষ বারবার বলার সুযোগ পেত!'


মোটা বলেই কি সিনেমায় লিড রোল পেতে ২৫ বছর লেগে গেল?

''টেলিভিশন নিয়ে আক্ষেপ নেই। অনেক ভাল রোল পেয়েছি। কিন্তু ছবিতে অন্যরকম বিষয় নিয়ে কাজ শুরু হল দেরিতে। কিন্তু ওই, বেটার লেট দ্যান নেভার। শিবু-নন্দিতা দি তো বরাবর মানুষের জীবন থেকে বিষয় নিয়ে ছবি করেন। সেই সঙ্গে জিনিয়ার লেখা, অরিত্রর পরিচালনা। সবকিছু নিয়ে ভরসা পাচ্ছি। এক বছর আগে জিনিয়া লেখাটা শুরু করতেই শিবু ফোন করে বলেছিল, তোর জন্য একটা দারুণ গল্প লেখা হচ্ছে। সেই গল্প নিয়েই ওঁদের আগামী ছবি 'ফাটাফাটি'।''


শুধু অপরাজিতাই নন, এই ছবির অন্যতম মুখ্য চরিত্রে আছেন অভিনেতা অম্বরীশ ভট্টাচার্য। ভাল অভিনেতা হিসেবে দারুণ-দারুণ রোল পাওয়া সত্ত্বেও তিনিও মানেন, মোটা-রোগা নিয়ে টিপ্পনী কাটার শেষ নেই। ইন্ডাস্ট্রিতে কোনওদিন এই নিয়ে কথা শুনতে না হলেও স্কুল-কলেজে তো শুনতেই হয়েছে। আর সমস্যাটা যেন প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। মানুষ যেন এখন আরও বেশি আক্রমণাত্মক চেহারা, রং এইসব বিষয় নিয়ে।

'ফাটাফাটি' ছবির গল্প লিখেছেন জিনিয়া সেন। ওঁর কলমই জন্ম দিয়েছিল 'ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি'। এবিপি আনন্দকে তিনি জানালেন, 'কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলেই আমরা আগে বিশ্লেষণ করে ফেলি, কে কতটা রোগা-মোটা হল। আমার চোখের সামনে একজনকে দেখেছি, সারাজীবন মোটা-মোটা শুনতে শুনতে রীতিমতো ডিপ্রেশনে চলে গেলেন। ফাটাফাটি, এমন এক দম্পতির কথা বলে, যারা ভালমন্দ খেয়ে-দেয়ে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু সমাজ তাদের ভাল থাকতে দেয় না। তারপর সেই একদিন বডি শেমিংকে দুয়ো দিয়ে আমার নায়িকা হয়ে উঠল নামি প্লাস সাইজ মডেল।'

জিনিয়া বলছেন, এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট একটা বডি শেপ ছাড়া ইন্ডাস্ট্রিতে নায়িকার চরিত্রে সুযোগ দেওয়া হয় না। কেউ শারীরিক সুস্থতার জন্য রোগা হতেই পারেন, কিন্তু সাইজ জিরোর অবশেসনটা কাটিয়ে ওঠা দরকার। 'আমি শুনেছি, রোগা থাকার জন্য কোনও কোনও মডেল তুলো খেয়ে থেকেছেন। এই ভাবনাটা থেকে বের হতে হবে। বিদেশে তো প্লাস সাইজ মডেল খুবই জনপ্রিয়। এই বিষয়টা কাটিয়ে উঠতে না পারলে অপরাজিতার মতো শিল্পীকে মুখ্য চরিত্র পেতে ২৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে।'

মনোস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, শরীরের আকার দিয়ে সবকিছু বিচার করা মোটেই ঠিক নয়। একজন মানুষকে বারবার মোটা বলে বলে টিটকারি দিলে তাঁর আত্মবিশ্বাসটাই একদিন ভেঙেচুরে যায়। সে নিজে যে জিনিসটি ভাল করতে পারে, তাকেও গুরুত্ব দেয় না। সে নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করে এই সত্যিটা। ব্যক্তিগত সম্পর্কেও এই ধরনের টিকাটিপ্পনী বিপদ ডেকে আনে। কোনও কারণে সম্পর্কে টানাপোড়েন এলে সে তাঁর শরীরের কাঠামোকেই দায়ী করে সে। যদি তা সত্যি হত, তাহলে তো সুন্দরী অভিনেত্রীদের সম্পর্কে কোনওদিন চিড় ধরত না! আমরা কারও সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেই আগে আলোচনা করি, কার কতটা চেহারাগত পরিবর্তন হল। কিন্তু সেটাই তো একজন ব্যক্তিমানুষের পরিচয় হতে পারে না।
মনোবিদ লোপামুদ্রা গোস্বামী বলছেন, 'একজন মা সমস্যা নিয়ে এসেছিল আমার কাছে। তাঁর মেয়ে অকারণেই নাকি খুব হিংসাত্মক আচরণ করে। ধাক্কা মারে। ঠেলে ফেলে দেয়। পরে আমরা কথা বলে জানতে পারি, ছোট থেকেই মেয়েটিকে মা রোগা-রোগা বলে হেনস্থা করতেন। এরপরই তার মধ্যে একটা ভাবনা তৈরি হয়, আমাকেও প্রমাণ করতে হবে শক্তি আছে। তাই সে মায়ের উপর গায়ের জোর ফলাতে শুরু করে।'

'ফাটাফটি' কি বদলাতে পারবে বডি শেমিংয়ের প্রবণতা? রোগা-মোটা নিয়ে টিটকারি কাটার মানসিকতা বদলাবে কি? বলবে সময়।