কলকাতা: পড়াশোনায় দুরন্ত। কিন্তু পড়ায় বিশেষ মন ছিল না। সেই যুবক সিনেমা ভালবাসতেন। সিনে জগতে কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে পরিবারের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধ করেই মুম্বই ছুটে এসেছিলেন। চাকরি হয়েছিল প্রোডাকশন হাউসের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট গোছের একটা। একদিন হঠাৎ সুযোগ। বিশেষ একটি কারণে প্রোডাকশন হাউসের মালিক তাঁকে ধরে বললেন আগামী সিনেমার নায়ক হতে হবে। কথা নেই বার্তা নেই- একেবারেই নায়ক? তায় আবার বিপরীতে সেই সময়ের সুপারস্টার দেবিকা রানি (Devika Rani)। সবাই ভাবল সিনেমা ডুববে--বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু বিধাতা আড়ালে হয়তো হেসেছিলেন। প্রথম সিনেমাই সুপারহিট। দর্শকদের মনে চিরস্থায়ী আসন তৈরি করেন নিলেন কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায়- সিনেপ্রেমীরা পেল নতুন সুপারস্টার অশোককুমারকে। সালটা ১৯৩৬। আর সেই প্রোডাকশান হাউসের নাম? হিমাংশু রায়ের বম্বে টকিজ (Bombay Talkies)।


ভারতীয় সিনেমার যে কজন লেজেন্ডের তালিকায় রয়েছেন- তাঁদেরই একজন অশোককুমার (Ashok Kumar) ওরফে দাদামণি। তিরিশের দশক থেকে প্রায় নব্বইয়ের দশক। স্ক্রিনে নিজের শিল্পের সাক্ষর রেখে গিয়েছেন অশোককুমার। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ২০০১-এ মারা যাওয়া পর্যন্ত প্রায় অবসর জীবন কাটিয়েছেন, কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি।


ভাগলপুরের গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার:
তৎকালীন বম্বে (Bombay) থেকে সারা ভারতের সিনেমা জগৎ কাঁপানো অশোককুমার কিন্তু একেবারেই সিনেদুনিয়ার কোনও পরিবারের ছিলেন না। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ভাগলপুরে তাঁর জন্ম। পিতৃদত্ত নাম কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায়। ভাগলপুরের গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার আক্ষরিক অর্থেই জমিদার ছিল। শিল্প-সান্নিধ্যও ঘটেছিল ছোটবেলা থেকেই। মায়ের দিকের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারও ছিল একই রকম। মামাবাড়ির পরিবেশেও ছোটবেলা থেকেই একাধিক তাবড় গল্পকার-সাহিত্যিকদের সঙ্গ পেয়েছিলেন। বড় হয়ে কলকাতায় আইন পড়তে এসেছিলেন কুমুদলাল। তখন থেকেই নাকি নাটক-সিনেমায় তাঁর আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। এরই মধ্যে তাঁর ভগ্নীপতি শশধর মুখোপাধ্যায় চাকরি পান হিমাংশু রায়ের বম্বে টকিজে। তাতেই একটু হলেও সুযোগ খুলে গেল কুমুদলালের। ভগ্নীপতির দৌলতেই আইন পড়া ছেড়ে সোজা বম্বে। সেখানেই বম্বে টকিজে তাঁর জন্য একটা ছোটখাট কাজও দেখে রেখেছিলেন শশধর। 


তিরিশের দশক। তখনও ভারত ব্রিটিশের অধীনে। তখনই রমরমিয়ে চলছে ভারতীয় সিমেনা (Indian Cinema)। সেই সময়ের মুম্বই (Mumbai) সিনে জগতে সবচেয়ে বড় নাম ছিল বম্বে টকিজ। আরও ভাল করে বললে হিমাংশু রায়ের বম্বে টকিজ। হিমাংশু এবং তাঁর স্ত্রী দেবিকা রানি- এই দুজনের প্রোডাকশন হাউস (Production House)। হিমাংশু-দেবিকা ছিলেন সেই সময়ের 'পাওয়ার কাপল'।


অশোককুমার হয়ে ওঠা:
সেইসময়ের বম্বে এসে কাজ শুরু করেছিলেন কুমুদলাল। পরিচালনা, সিনেমা সংক্রান্ত অন্য কাজে ঝোঁক থাকলেও, অভিনয়ের কথা নাকি তিনি কখনই ভাবেননি। তবুও এল প্রস্তাব। আর সেটা সরাসরি হিমাংশু রায়ের কাছ থেকে। বিভিন্ন রকম কারণ শোনা যায়- তার মধ্যে না গিয়েই বলা যায়- সেই সময়ের বম্বে টকিজের নায়ক নাজমুল হাসানের অনুপস্থিতিই ছিল এই সুযোগ মূল কারণ। তখন 'জীবন নাইয়া'র শুটিং শুরু হবে। এদিকে নাজমুলের অনুপস্থিতির কারণে নতুন নায়কের (Hero) দরকার। হিমাংশু রায়ের মনে ধরল তাঁর প্রোডাকশন হাউসে কাজ করা তরুণ কুমুদলালকে। শুরুতে নাকি বিস্তর আপত্তি করেছিলেন তিনি। বাড়ির লোকজনের আপত্তির কথাও বলেছিলেন। বেঁকে বসেছিলেন পরিচালক ফ্রানজ অস্টেনও। কিন্তু হিমাংশু রায় নাছোড়। এই সময়েই কুমুদলালের বদলে তাঁর স্ক্রিন নেম হল অশোককুমার। শেষ পর্যন্ত শুটিং হল, সিনেমা রিলিজ করল। আর দর্শকদের মনে ধরল অশোককুমারকে। দুরন্ত হিট হওয়ার পর ওই বছরেই দেবিকার সঙ্গে জুটিতেই রিলিজ করল 'অচ্ছুত কন্যা'। সেটাও দুরন্ত হিট। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। হিন্দি সিনেমার নতুন সুপারস্টারের আসনে জায়গা করে নিয়েছিলেন অশোককুমার। সারা জীবনে বিভিন্ন চরিত্রে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। সবকটিকেই ভালবেসেছেন দর্শকরা। বচন, ইজ্জত থেকে ১৯৪৩-এর 'কিসমত'- সবরকম চরিত্রেই সমান সাবলীল।


হিমাংশু রায়ের মৃত্যুর পর বম্বে টকিজের হাল ধরেছিলেন দেবিকা রানি। কিছুদিন বম্বে টকিজের দেখভাল করেছেন অশোক কুমার। তারপরে অশোক কুমার, শশধর মুখোপাধ্য়ায়, জ্ঞান মুখোপাধ্য়ায়, রায় বাহাদুর চুনিলাল মিলে তৈরি করেন'ফিল্মিস্তান' স্টু়ডিও। তার মাধ্যমেও বহু প্রতিভাকে সুযোগ দিয়েছেন তিনি। সাদাত হাসান মান্টো এবং ঋত্বিক ঘটকও আলাদা করে পরিচিতি পাওয়ার আগে ফিল্মিস্তান প্রোডাকশন হাউসে স্ক্রিনরাইটার হিসেবে কাজ করেছেন। ফিল্মিস্তানের (Filmistan) ব্য়ানারে একাধিক সিনেমাও বেরিয়েছিল- 'চল চল রে নওজওয়ান', 'দো ভাই' থেকে শুরু করে 'জাগৃতি', 'নাস্তিক', 'পেয়িং গেস্ট'। কেরিয়ারে অন্তত তিনশো সিনেমা করেছেন অশোককুমার (Ashok Kumar)। 'পরিণীতা', 'হাওড়া ব্রিজ', 'কানুন', 'বন্দিনী', 'জুয়েল থিফ', 'মহল', 'পাকিজা', 'গুমরাহ', 'ভিক্টোরিয়া নম্বর ২০৩'- তালিকা শেষ হবে না। শুধু অভিনয়ই নয়- নতুন প্রতিভা খুঁজে আনা, তাঁর জন্য মঞ্চের ব্যবস্থা করা- সবই করেছেন বাঙালি অশোককুমার- যিনি নিজে আরও এক লেজেন্ড কিশোরকুমারের দাদা।


ভারতীয় সিনেমার এই লেজেন্ড একাধিক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৮ সালে তিনি সম্মানিত হয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে (Dadasaheb Phalke Award) পুরস্কারে। ১৯৯৮ সালে পদ্মসম্মান পান তিনি। ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন ভারতীয় সিনেমার এই স্তম্ভ।


তথ্যসূত্র:
চলচিত্র প্রবেশিকা: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
অশোককুমার, হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস: নবেন্দু ঘোষ
আনন্দবাজার পত্রিকা


আরও পড়ুন: বিলেতের মাটিতে বাংলার নাগরদোলা! চন্দননগরের আলো! আয়োজনে 'আড্ডা'