কলকাতা: মাত্র ষোলো-সতেরো বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করেই কেটে যায় দুর্গাপুজো। তবে ছেলেবেলায় দাদু-দিদা-ঠাকুর্দা-ঠাকুমা চারজনকেই পাওয়ায় তাঁদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার স্মৃতিও রয়েছে সঙ্গীতশিল্পী নীল দত্ত-এর। এবিপি লাইভকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ভাগ করে নিলেন ছেলেবেলার পুজো-শো-গানের স্মৃতি।
কখনও কোনও পুজোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না নীল দত্ত। তবে একদম ছোটবেলায় ঠাকুর্দা ওই পাঁচদিনের যে কোনও একদিন রিক্সা করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন তাঁকে, দাদুও নিয়ে বেরোতেন। এছাড়া ছেলেবেলায় নতুন জামার সঙ্গে আসত পূজাবার্ষিকী। নীলের কথায়, 'বাড়ির সকলে নিয়ম করে পূজাবার্ষিকী পড়তেন, সেই থেকে আমারও ইচ্ছেটা তৈরি হয়। এছাড়া একদম ছোটবেলায় ভাই-বোনেরাও আসতেন পুজোর সময়ে।'
তবে খানিক বড় হওয়ার পরের পুজো? নীলের কথায়, 'আমার টিন-এজে পুজো মূলত দিল্লি, মুম্বই, ব্যাঙ্গালুরু সব জায়গায় গিয়ে শো করেই কেটে গেছে। আমাদের একটা বন্ধুদের গ্রুপ আছে। একটা সময় পর্যন্ত আমরা নিয়ম করে ষষ্ঠীতে দেখা করতাম এবং লাঞ্চে যেতাম। কিন্তু বেশিরভাগেরই বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এখন সেটাও প্রায় হয় না বললেই চলে। ইচ্ছে না থাকলেও পুজোতেই অনেক অনুষ্ঠানও আসে।'
এখন পুজোয় অনুষ্ঠান না থাকলে ভিড় এড়িয়ে বাড়িতে রান্নাবান্না করা, আড্ডা দেওয়া বন্ধুদের সঙ্গে, এমনটাই বেশি পছন্দ করেন নীল। আর ছোটবেলায় ব্যাপারটা কেমন ছিল? 'ছোটবেলায় প্রতিদিন একটা করে নতুন জামা পরে বেরোনো, কোথাও না কোথাও একটা খাওয়া, একটা ছোট্ট পকেটমানি নেওয়া, এগুলো করেছি। ছোটবেলায় এমনকী কলেজেও পার্কস্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়ার মতো সামর্থ্য থাকত না, তাই আমাদের খাওয়া মানে ওই এগরোল বা ফুচকা। অবশ্য কখনও দামী রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়ার কথা তখন মনেও হত না। উদ্দেশ্য থাকত, কয়েকটা ইন্টারেস্টিং ঠাকুর দেখা, খানিক আড্ডা দেওয়া-গল্প করা। বিশেষত স্কুল বা কলেজের বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াটাই মূল লক্ষ্য থাকত,' বলছেন তিনি।
যাঁরা নীল দত্তকে মোটামুটি চেনেন, তাঁরা এটাও জানেন যে তিনি বেশ খাদ্যরসিক মানুষ। কিন্তু সারা বছর যাই খাওয়া হোক না কেন, দুর্গাপুজো মানেই তাঁর কাছে বাড়ির বাঙালি খাবারই শ্রেষ্ঠ। যেমন দশমীর দিন এখনও ঐতিহ্য বজায় তাঁদের বাড়িতে ঘুগনি, কুচো নিমকি, মালপোয়া তৈরি হয়।
কিন্তু এত ছোট বয়স থেকে পুজোর সময়ে বাইরে অনুষ্ঠান করতে খারাপ লাগত না? 'খুব বিরক্ত লাগত,' অকপট স্বীকারোক্তি নীল দত্তের। 'সবকিছু ছেড়ে ঠিক পঞ্চমীর দিন ফ্লাইট ধরে বাইরে চলে যাওয়া...', তবে তাঁর আরও বক্তব্য, 'আমি কখনও টাকার জন্য তো শো করিনি, গানবাজনা আমার প্যাশন।' তাই হয়তো সেই বিরক্তিটা বেশিদিন বা বেশিক্ষণ স্থায়ীও হয়নি। এমনকী বিদেশে অনুষ্ঠান করেও তাঁরা বেশ ভালই সাড়া পেয়েছেন।
বাবা অঞ্জন দত্তের প্রথম অ্যালবাম,'শুনতে কি চাও' মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৪ সালে পুজোর ঠিক আগে, অগাস্ট মাসে। অঞ্জন দত্তের সুর, কণ্ঠ। গিটার সঙ্গতে নীল দত্ত। 'আমার পরিষ্কার মনে আছে, পুজোয় আমার পাড়ার মাইকে "রঞ্জনা আমি আর আসব না" গানটা বাজত। সেটার একটা অন্যরকম অনুভূতি ছিল।' আর তখন নীল দত্তের বয়স মাত্র ষোলো, তাঁর কথায় 'স্যুইট সিক্সটিন'।
যদিও নীল জানাচ্ছেন, ওই বয়সে যত না তার থেকে বেশি কলেজে পড়াকালীন বা কলেজ পাস করার পর পুজোয় অনুষ্ঠান থাকলে একটু খারাপই লাগত। 'তখনই তো পুজোর আকর্ষণ বেশি। পুজোয় সব বান্ধবীরা সেজেগুজে বেরোবে, বা কোনও বান্ধবীর সঙ্গে ডেটে যাওয়া হবে। কিন্তু সেই সময়গুলোও আমি শো-ই করেছি।' হাসতে হাসতে নীল বলেন, 'আমার যখন গার্লফ্রেন্ড ছিল, তখনও একটা পুজোতে একের পর এক নানা রাজ্যে শো করেছি। টানা তিন দিন প্রায় না ঘুমিয়ে কলকাতা পৌঁছে বান্ধবীর সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেছি।'
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রচুর গান-সুর শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন নীল দত্ত। কিন্তু এখনও প্রথম অ্যালবাম 'শুনতে কি চাও'-এর গান শুনলে তাঁর পুজোর কথা মনে পড়ে। 'কারণ যেখানেই যাচ্ছিলাম, সেটা লেক গার্ডেন্স হোক বা যোধপুর পার্ক বা গড়িয়াহাট, হয় সেখানে 'হরিপদ' বাজছে বা কোথাও 'দার্জিলিং' বাজছে। সেটা একটা অদ্ভূত ব্যাপার।' তবে একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাঁর মতে এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা, পছন্দ সবই বদলেছে। এখন ক্যাসেট বা অ্যালবাম কেনার প্রথাটাই নেই। সবই অনলাইনে এক ক্লিকেই মুঠোবন্দি। ফলে একটা সময়ের পর নীল দত্তও 'পুজোর গান' তৈরির ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছেন।
আরও পড়ুন: মায়ের কাছে মার খেয়েও পাড়ার প্যান্ডেলে রাত জাগতাম: শাশ্বত