পৃথা দাশগুপ্ত, কলকাতা: ৮ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছে ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস্ - দ্য সিক্রেটস অফ ডাম্বলডোর’ (Fantastic Beasts: The Secrets of Dumbledore), যা কিনা একাদশতম উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড ফ্রাঞ্চাইজি (Wizarding World Franchise)। এই ছবিটি ‘দ্য ক্রাইমস অফ গ্রিন্ডেলওয়াল্ড’ -এর সিকুয়্যেল। হ্যারি পটারের (Harry Potter) অনুরাগীদের মধ্যে এই সিনেমাকে ঘিরে উত্তেজনা তো ছিলই। যাঁরা এর আগে কোনও দিন হ্যারি পটার দেখেননি, তাঁরাও এই ছবি উপভোগ করবেন। যদিও সারা পৃথিবীতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে ছবিটিকে ঘিরে। ২০২০ সালে ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস্ - দ্য সিক্রেটস অফ ডাম্বলডোর’-এর শ্যুটিং শুরু হলেও অতিমারীর কারণে তা বন্ধ হয়ে। তারপর স্থির হয় ২০২১-এর ১৫ জুলাই মুক্তি পাবে ছবিটি। কিন্তু আবার পিছিয়ে যায় মুক্তির তারিখ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে ভারতে প্রফেসর আলবাস ডাম্বলডোরের ভক্তরা ইংল্যান্ডের অনুরাগীদের সঙ্গে একইদিনে ছবিটি দেখার সুযোগ পেল। মার্কিন মুলুকে এই উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডের সাক্ষী হতে এক সপ্তাহ বেশি অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ১৫ এপ্রিল আমেরিকায় মুক্তি পাবে ছবিটি।
‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস্ - দ্য সিক্রেটস অফ ডাম্বলডোর’ রিভিউ
গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক থাকার কারণে ডাম্বলডোর নিয়োগ করে নিউট, তার ভাই থেসিয়াস, আমেরিকান উইচ ল্যালি, ফ্রান্সের উইজার্ড ইউসুফ কামা, আর আমেরিকান জ্যাকব কোয়ালস্কিকে। গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের দলে ইউসুফ কামাকে গুপ্তচর বানিয়ে ঢুকিয়ে দেন ডাম্বলডোর। তারপর গল্প এগোতে থাকে বার্লিনে।
সিনেমার শুরুতেই দেখা যায় কফি শপে ডাম্বলডোর আর গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের দেখা হয়। তাঁদের কথায় স্পষ্ট হয়ে যায়, দুজনের মধ্যে শুধু বন্ধুত্ব নয়, প্রেমের সম্পর্কও ছিল। তারপর শুরু হয় প্রতিশোধ আর প্রতিরোধের গল্প। সততার পক্ষে ডাম্বলডোর আর গ্রিন্ডেলওয়াল্ড চায় উইজার্ড দুনিয়ার উপর একছত্র আধিপত্য।
গুইলিনের জঙ্গলে মা কুইলিন জন্ম দেয় যমজ সন্তানের। কুইলিন হল সেই জাতীয় প্রাণী যারা মানুষের অন্তর আর ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। এই প্রাণী একমাত্র নতমস্তক হয় ভাল আর যোগ্য ব্যক্তির সামনে। গ্রিন্ডেলওয়াল্ড ক্রেডেন্সকে পাঠিয়ে দেয় মা কুইলিনকে খুন করে তার সদ্যোজাত সন্তানকে বন্দি করে নিয়ে আসার জন্য। গ্রিন্ডেলওয়াল্ড সদ্যোজাতকে মেরে ফেলে। কিন্তু সে জানত না যে সেই সদ্যোজাতের এক ভাইও আছে। যার প্রাণ বাঁচিয়ে দেয় নিউট। ডাম্বেলডোর থেসিয়াস আর সান্তোসকে বাঁচিয়ে আনার দায়িত্ব দেয় লিলি আর নিউটকে। গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের জার্মান 'মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিক' তাদের বন্দি করে রেখেছে। নিজের অধিপত্য কায়েম করতে তাদের মৃত্যুদণ্ড ধার্য করেছে। থেসিয়াস আবার নিউটের ভাই। নিউট জার্মানির গোপন কারাগার থেকে ভাইকে মুক্ত করে হগওয়ার্ডে পৌঁছে যায়। কিন্তু জেকব আর লিলি পড়ে বিপদে। গ্রিন্ডেলওয়াল্ডকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করা হয় তাদের। এদিকে ক্রেডেন্সকে গ্রিন্ডেলওয়াল্ড পাঠায় ডাম্বলডোরকে মেরে ফেলার জন্য। ডাম্বলডোর অনায়াসেই ক্রেডেন্সকে পরাজিত করে। ক্রেডেন্সের উপর ফিনিক্সের ছায়া ‘অর্ডার অফ ফিনিক্স’ মনে করিয়ে দেবে দর্শকদের। ক্রেডেন্সের মৃত্যু যে আসন্ন সেই বার্তাই দেয় ফিনিক্স।
ভুটানে উইজার্ড দুনিয়ার সবাই মিলিত হয় নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য। প্রাচীন পদ্ধতি মেনে কুইলিন যার সামনে মাথা নত করবে সেই হবে নেতা। কুইলিনের সঙ্গে হেঁটে আসতে আসতে গ্রিন্ডেলওয়াল্ড যাদুবলে প্রভাবিত করে তাকে, আর নিজেকে উইজার্ড দুনিয়ার একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রমাণ করে। এরপর ক্রেডেন্স কুইলিন, নিউট সকলের সামনে গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে। তারপর কুইলিনের মৃত যমজ ভাইকে সবার সামনে নিয়ে আসে। তখন সেই কুইলিন হেঁটে গিয়ে ডাম্বলডোরের সামনে বসে। ডাম্বলডোর ব্রেজিলের সান্তোসকে উইজার্ড দুনিয়ার যোগ্য নেত্রী ঘোষণা করেন। তারপর কুইলিন সান্তোসের সামনে মাথা নত করে। এরপর দেখা যায় যে গ্রিন্ডেলওয়াল্ড ক্রেডেন্সকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। ডাম্বেলডোর আর গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের মধ্যে ব্লাডপ্যাক্ট ভেঙে যায়। দুজনের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হয়। চিরাচরিত গল্পের বাঁধা ছকেই শেষ অঙ্কে জিতে যায় নায়ক আর খলনায়ক পরাজিত হয়। অর্থাৎ ডাম্বলডোর জেতে, গ্রিন্ডেলওয়াল্ড হেরে যায়।
ছবির অন্যান্য খুঁটিনাটি
এই সিনেমায় ক্যামেরা, স্পেশাল এফেক্ট, সাজসজ্জা, ক্যানভাস এক্কেবারে নিখুঁত। এমনকি পিরিয়ড ড্রামার সমস্ত খুঁটিনাটি নির্ভুল। ইংরেজ আর জার্মান মহিলাদের গয়না বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দুই দেশের পার্থক্যের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। তবে এরই সঙ্গে রাজনৈতিক আধিপত্যও চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রিন্ডেলওয়াল্ডকে হিটলার আর ডাম্বলডোরকে চার্চিল বানাতে কোনওরকম কার্পণ্য করেননি জে কে রাওলিং। উইজার্ড দুনিয়ায় কোনওরকম রক্তের মিশ্রণ মেনে নিচ্ছে না গ্রিন্ডেলওয়াল্ড। তার জেতার জন্য সমস্তরকমের ভুল পথ বেছে নিতে সে দ্বিধা করছে না। গ্রিন্ডেলওয়াল্ড নিজের আধিপত্য সারা পৃথিবীর উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। উল্টোদিকে ডাম্বলডোর ফ্রান্স, আমেরিকা সবাইকে নিয়ে গ্রিন্ডেলওয়াল্ডকে হারাতে এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত। শেষেও গ্রিন্ডেলওয়াল্ড বলছে যে সে কোনওদিন উইজার্ড দুনিয়ার শত্রু ছিল না। তাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হল। এরপর ডাম্বেলডোরের সৌজন্যে একজন মহিলা নেতা হিসেবে নির্বাচিত হলেন। এক্ষেত্রেও ডাম্বলডোর উদার ও নারীবাদী। ডাম্বেলডোরকে এমন যুক্তিযুক্ত ভাবে সততার প্রতিমূর্তি বানাতে গিয়ে গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের চরিত্রটিকে করে দেওয়া হল কালো, ধূলি-ধূসরিত। ছবিতে এই অতি সরলীকরণ ও ইংরেজ জাত্যাভিমান এতটাই প্রকট যে কোনও দর্শক ২০২২-এ দাঁড়িয়ে অস্বস্তিবোধ করতেই পারেন। একজন ভারতীয় বাঙালি দর্শকের মনে পড়তেই পারে এই চার্চিলের জন্যই এই দেশকে যুদ্ধ দেখতে হয়েছে, দেশভাগ দেখতে হয়েছে, মন্বন্তর দেখতে হয়েছে। চার্চিল-হিটলার থেকে ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড আজও যদি বেরোতে না পারে, তাহলে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নতুন প্রজন্মকেও ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিষয়ে প্রশ্ন করতে দিতেই চায় না তারা।
তবে ইতিহাসকে সরিয়ে ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ডের অভিপ্রেত রোলারকোস্টার রাইডের উত্তেজনা পেতে চাইলে ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস্ - দ্য সিক্রেটস অফ ডাম্বলডোর’ দেখার জন্য থিয়েটারমুখী হতেই পারেন দর্শক।