পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা: নাস্তিকেরা তোমায় মানে না, নারী
দীর্ঘ ঈ-কারের মত তুমি চুল মেলে
বিপ্লবের শত্রু হয়ে আছো!
এমনকি অদৃশ্য তুমি বহু চোখে
কত লোকে নামই শোনেনি
যেমন জলের মধ্যে মিশে থাকে
জল-রং আলো-
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার আয়নায় এক এমনই নারীর ছবি দেখি। এমনই কিছু প্রশ্ন দেখি। এমনই এক..., না, এমনই অনেক নারীর ছবি দেখি সঞ্জয়লীলা বনশালীর (Sanjay Leela Bhansali) সিনেম্যাটিক ক্যানভাসে। 'গঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি'তে (Gangubai Kathiawadi)। শুক্রবার মুক্তি পেল আলিয়া ভট্ট (Alia Bhatt), অজয় দেবগন (Ajay Devgn), বিজয় রাজ, ইন্দিরা তিওয়ারি, সীমা পহওয়া অভিনীত ‘গঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি’।


২ ঘণ্টা ৩৪ মিনিটের ছবি। এবং ছবির পুরোটা জুড়ে শুধুই আলিয়া, আলিয়া, এবং আলিয়া। বাকি সবাই পার্শ্বচরিত্র। এস হুসেন জাইদির লেখা বই ‘মাফিয়া কুইনস অফ মুম্বই’-এর পটভূমিতে এই ছবির কাহিনি বুনেছেন সঞ্জয়লীলা। নিষিদ্ধপল্লি কামাথিপুরার এক সত্য কাহিনি। লালবাতি এলাকার এক যৌনকর্মীর অসাধারণ লড়াইয়ের কাহিনি।


ছবির গল্প শুরু হচ্ছে স্বাধীনতার কিছু বছর পর। মুম্বই তখন বম্বে। সিনেমার চুম্বকে এখনকার মতই তখনও কত স্বপ্ন শুধুই বম্বেগামী। কাথিয়াওয়াড়ের ব্যারিস্টারের মেয়ে গঙ্গা হরজীবনদাসও স্বপ্ন দেখে সে নায়িকা হবে। অভিনয় করবে দেবানন্দের সঙ্গে। গঙ্গার এই স্বপ্নকে ইন্ধন দেয় তাঁর প্রেমিক রমনিক লাল। সে গঙ্গাকে বোঝায়, স্বপ্ন সত্যি করতে হলে বম্বে যেতে হবে। বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই যেতে হবে। কারণ, বাড়ির কেউ এই পরিকল্পনার কথা জানলে স্বপ্ন পূরণের আর কোনও সম্ভবনাই থাকবে না। রমনিকের হাত ধরে গয়না, টাকা-পয়সা নিয়ে বাড়ি ছাড়ে গঙ্গা। ট্রেনে চেপে এসে পৌঁছোয় মায়ানগরীতে। তারপর গন্তব্য রমনিকের মাসির বাড়ি। কিন্তু মাসির বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই মনটা কেমন করে ওঠে গঙ্গার। বাড়ির এ কেমন চেহারা? এরা কেমন নারী? রমনিক গঙ্গাকে বসিয়ে রেখে কোথায় গেল? গঙ্গা রমনিকের মাসির মুখোমুখি হয়। এক ছুটে যেতে চায় রমনিকের কাছে। কিন্তু কোথায় রমনিক? নিয়তি নিষ্ঠুর হাসি হাসে। রমনিক গঙ্গাকে হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে নিষিদ্ধপল্লি কামাথিপুরায়। এরপর? নিয়তির নিয়মেই কাহিনি এগোয়। গঙ্গার মৃত্যু হয়, জন্ম নেয় গঙ্গুবাঈ। 


গঙ্গুবাই আদতেই এক বৈপ্লবিক চরিত্র। নিষিদ্ধপল্লির কলঙ্কের কাদায় গঙ্গু চাপা পড়ে যায়নি। নারীর অধিকার নিয়ে সরব হয়েছে। পেশার অধিকার নিয়ে সরব হয়েছে।  পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে প্রশ্ন করেছে। গঙ্গুর কথায়, গঙ্গুর সাহসে, গঙ্গুর বুদ্ধিমত্তার সামনে নতজানু হয়েছে প্রবল পৌরুষও। নিষিদ্ধপল্লির ছোট ছোট মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে সরব গঙ্গুর কাছে যখন তাঁদের বাবার নাম জানতে চাওয়া হয়, তখন সিনেমাপ্রেমী গঙ্গুর সেই সিনেম্যাটিক জবাব, ‘বাপ কা নাম দেবানন্দ’। কামাথিপুরার নিষিদ্ধপল্লি থেকে গঙ্গুর কণ্ঠ পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রীর কানেও। দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে নিজের কথা, নিজের মতো হাজারো মহিলাদের কথা অকুতোভয়ে, নির্দ্বিধায় জানানোর সাহস রাখে গঙ্গু। গঙ্গু দিন বদলের স্বপ্ন দেখে। কামাথিপুরার অন্ধকার থেকে এক কিশোরীকে মুক্তি দিয়ে বাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্তও নিতে পারে। আবার সেই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক অস্ত্রও করতে পারে। রাজনীতির জটিল অলিগলিতে গঙ্গু পথ হারায় না। গঙ্গু জিতে যায়। গঙ্গুর সঙ্গে জেতে তার মতোই অসংখ্য নারী। কামাথিপুরা গঙ্গুর নিয়ন্ত্রণে আসে।


আরও পড়ুন: Gangubai Kathiawadi Box Office: প্রথম দিনেই প্রায় ১০ কোটি টাকার ব্যবসা 'গঙ্গুবাঈ কাঠিয়াওয়াড়ি'র


আলিয়া গঙ্গুর চরিত্রের জন্য নিজেকে চুরমার করে ভেঙেছেন। সঞ্জয়লীলা বনশালীর ছবিতে সুবিশাল ফ্রেমে গঙ্গুর চরিত্র 'লার্জার দ্যান লাইফ'। কিন্তু পুরো ছবি জুড়ে আলিয়াকে শুধু অসাধারণ বললে কম বলা হবে। একার কাঁধে পুরো ছবি টেনে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। গঙ্গুর সংলাপে কত ছোট ছোট মুহূর্ত যেন চিরদিনের জন্য মনে গেঁথে যায়। সাদাকে নতুন করে চেনায় গঙ্গু। সাদাকে আলাদা করে চেনায়। চাঁদের মত সাদা, মেঘের মত সাদা, গোলাপের মত সাদা, কাগজের মত সাদা, নুনের মত সাদা, কচ্ছের রণের মত সাদা?  আলিয়ার চোখ থেকে বলিষ্ঠ শরীরি ভাষা গঙ্গুবাঈয়ের চরিত্রে প্রাণসঞ্চার করেছে। মাফিয়া ডন করিম লালার ভূমিকায় অজয় দেবগনের চরিত্রটি ছোট হলেও দমদার। করিম লালার এন্ট্রিই যেন তুবড়ির মত জ্বলে ওঠে। অনবদ্য অভিনয় করেছেন বিজয় রাজও। রাজিয়াবাঈয়ের চরিত্রে বিজয়ের অভিনয়ের কোনও তুলনা নেই। ছবি দেখতে দেখতে মনে হতেই পারে, রাজিয়া আর গঙ্গুর লড়াইটা যেন দানা বেঁধেও বাধল না। কোথায় যেন একটা খামতি রয়ে গেল। ধোঁয়াই উঠল শুধু, আগুন জ্বলল না। একটি গানের দৃশ্যে দেখা গেল হুমা কুরেশিকেও। সাংবাদিকের ভূমিকায় জিম সার্ভের অভিনয়ও নজরকাড়া। গঙ্গু যখন একবার রমনিককে সামনে পেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা কল্পনা করে, তখন সাংবাদিকসুলভ বিচক্ষণতা থেকেই সে গঙ্গুকে বলে, রমনিককে সামনে পেলে গঙ্গুর ভেতরের আগুনটা নিভে যাবে। পুরোনো কথা মনে রেখে লাভ লেই। এখন শুধুই এগিয়ে যেতে হবে। সিনেম্যাটোগ্রাফার সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের ক্যামেরা কী অবলীলায় নিষিদ্ধ পল্লির কর্কশ চেহারাতেও একটা শৈল্পিক ছোঁওয়া দিয়েছে। তবে সঞ্জয়লীলার এই ছবিতে গানের ব্যবহারে নতুনত্ব নেই কোথাও। নিজের চেনা ফর্ম্যাটেই গান সাজিয়েছেন সঞ্জয়। 


'গঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি' প্রতিবাদের ছবি। এই ছবি এক নারীর উচ্চকিত কণ্ঠ। ছবি শেষ হওয়ার পরেও সেই কণ্ঠের রেশ রয়ে যায়। চোখের আগুনে দহনের জ্বালা রয়ে যায়। সমাজের মিথ্যে পুরুষত্বের লজ্জাও রয়ে যায় বৈকি।