''অভিনয় তো 'ঝুঁটি'। আর গানটা আমি গাই হৃদয় থেকে। আর হৃদয় থেকে যে কাজ মানুষ করে, তা মানুষের হৃদয় অবধি পৌঁছে যায়। তাই তো আমি বলেছিলাম, দাদা আমায় অভিনয় করিও না। আমি গানটাই গাই।'' কিন্তু তা হয়নি। দেশ গায়ক কিশোর কুমারকে (Kishore Kumar ) চেনার আগে চিনল অভিনতা কিশোরকে। জন্মসূত্রে আভাস, কর্মসূত্রে কিশোর। তিনি যে শুধু গানই গাইতে চেয়েছিলেন, সে কথা নিজেই জানিয়েছিলেন আরেক প্রবাদপ্রতিম শিল্পীকে। লতা মঙ্গেশকরের (Lata Mangeshkar) নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কিশোর বলেছিলেন,গান গাওয়াতেই তাঁর আনন্দ। অথচ দাদার ইচ্ছা মতো কিশোর কুমার প্রথমে কেরিয়ার শুরু করেন অভিনয় দিয়ে। কিন্তু অভিনয়ের জন্য নিজের পরিচর্যা করতে বিরক্তই হতেন তিনি। ছোট থেকে ঈশ্বরের মতো মানতেন সঙ্গীতশিল্পী কে এল সায়গলকে। তাঁর ছবিতে প্রণাম করেই শুরু হত তাঁর দিন। 


 লতা ও কিশোরের প্রথম সাক্ষাতের মজার স্মৃতি


দূরদর্শনের জন্য একবার কিশোর কুমারের সাক্ষাৎকার ( Kishore Kumar Interview With Lata Mangeshkar  ) নিয়েছিলেন লতা স্বয়ং! লতা মঙ্গেশকর কারও ইন্টারভিউ নিচ্ছেন, এমন উদাহরণ তো বিরল। সেখানেই কিশোর বলেছিলেন কীভাবে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে প্রথম দেখা তাঁর। মজার কথা হল, কেউ কাউকে চেনেন না ! দুজনেই সফর করছেন লোকাল ট্রেনে। একই স্টেশনে নামলেন। তারপর লতাও উঠলেন টাঙ্গায়, আর কিশোরও। ততক্ষণে লতা মঙ্গেশকর তো ভেবেই নিয়েছেন, এ ছেলে তাঁকে ফলো করছে। স্টুডিওর গেট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছলেন দুজনে। তারপর সোজা সঙ্গীতকার ক্ষেমচন্দ প্রকাশের কাছে। পৌঁছে তো দুজনেই তাজ্জব। হয়ত নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জাও পেয়েছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী। আর সেই দিনই রেকর্ড হল তাঁদের প্রথম ডুয়েট। জিদ্দি ছবির জন্য । তারপর তো কিশোর-লতা মানেই কালজয়ী সৃষ্টি। 


অনেকটা পথ এগিয়ে গেলেও এই  ক্ষেমচন্দ প্রকাশের অবদান কোনওদিন ভোলেননি তিনি। প্রথমে যিনি বলেছিলেন, তোমার গলায় মডিউলেশন নেই। কিশোরকে নিজের মনের মতো করে তালিমও দিয়েছিলেন তিনি। গাইয়েছিলেন লতার সঙ্গে। যাকে বলা যায় ইতিহাসের সূচনা, যুগলে গেয়েছিলেন তেরে বিনা জিন্দগি সে থেকে তুম আ গ্যয়ে হো-র মতো কালজয়ী গান। 


প্রথাগত তালিমই ছিল না কিশোরের !


লতাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছিলেন , আমি তো তোমার অনেক পরে এসেছি । আমার তো সা রে গা মা পা ধা নি সা র - তালিমও ছিলনা তেমন। আমার ভক্তরা একথা মানবে না, কিন্তু তুমি তো জানো ! 


সেই সাক্ষাৎকারেই লতা মঙ্গেশকর প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা আমার সঙ্গে গান গাইতে আপনার কেমন লাগত? কিশোরের জবাব, তুমি এত সৌম্য, শান্ত ভাবে রেকর্ডিং করতে...আর আমার মনে হত, এই যে গান গাইতে গাইতে আমি নানারকম অ্যাকশন করি, তোমার যদি খারাপ লাগে ! লতার ঝটিতি জবাব, না ... না আমার খারাপ লাগত না। আমার মনে হয়, আমি আপনার মতো ওরকম গাইতে গাইতে এদিক ওদিক করে ভঙ্গিমা করতে পারতাম না। কিশোরের জবাব, তুমি তোমার জায়গা থেকে একদম ঠিক। আসলে আমি তো অভিনয় দিয়ে শুরু করেছিলাম, তারপর গান। তাই গান গাইতে গাইতে ওই অভিনেতা সত্তাটা বেরিয়ে আসত। 


দাদার জন্মদিনেই ভাইয়ের চলে যাওয়া 


দাদা অশোক কুমারের ইচ্ছেতেই তাঁর অভিনয়ে আসা। গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারে দাদামণির কথা ছিল বেদবাক্যি। দাদার কথা অমান্য করার সাধ্য ভাইয়ের ছিল না। হাসি, রাগ, অভিমান সবই দাদাকে ঘিরে। ভাইয়ের কথা ফেলতে পারতেন না অশোকও। কিশোরের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভাইয়ের আবদার রেখেছিলেন অশোক।  জীবনের শেষদিনে দাদাকে বড়সড় ঘা দিয়েই চলে গিয়েছিলেন কিশোর। 


সালটা ১৯৮৭। সেদিন ছিল দাদামণির জন্মদিন। ১৩ অক্টোবর। গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারে সেদিনটা দারুণ আনন্দের । জানা যায়, সেদিন সকাল সকাল দাদামণিকে ফোন করেছিলেন কিশোর। বলেছিলেন, জন্মদিনটা দাদার সঙ্গেই কাটাবেন। অশোক কুমার সে-বছর জন্মদিন পালন করতে চাননি। সে বছরই পত্নীবিয়োগ হয়েছিল তাঁর। তাই মন চাইছিল না। এদিকে কিশোরও নাছোড়বান্দা। জন্মদিনে দাদাকে একলা ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত অশোক নাকি রাজি হন, বলেন কিশোরের বাড়িতে আসবেন বিকেলে। সেই আনন্দে বাড়িতে দারুণ আয়োজন করে ফেললেন কিশোর, বলে দিলেন আজ দাদার পছন্দের সবরকম খাবার হবে। কিন্তু হায় !স্ত্রী লীনা চান্দাভাকরের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সেদিনই চলে যান কিশোর। অশোক কুমার এসেছিলেন। এইভাবে যে জন্মদিনে ভাইকে হারিয়ে ফেলবেন,ভাবেননি তিনি। ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলেন।  


মৃত্যুর পর ২ দিন বরফের উপর রাখা হয়েছিল। ছেলে অমিত কুমার তখন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি ফেরা অবধি অপেক্ষা করা হয়। মুম্বইয়ের আর কে স্টুডিওয় হাজার হাজার অনুরাগী এসে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। তারপর তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় মধ্যপ্রদেশের খান্ডওয়ায়, যেখানে জন্মেছিলেন তিনি। 


ঘরে ফেরার টান


বরাবর নিজের জন্মস্থানের প্রতি আলাদাই মায়া ছিল কিশোরের । সেকথা লতা মঙ্গেশকরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও জানিয়েছিলেন কিশোর। তিনি বলেছিলেন, জীবনে এত চড়াই-উতরাই দেখেছেন, এখন মনে হয় এই সময় চলে যাওয়াই ভাল। শুধু আমার ঘর, আমার দেশ আমায় ডাকে। আমার কোনও দুঃখ নেই। আমি খুশি ।  শুধু মনে হয় যত তাড়াতাড়ি হোক, আমি আমার নিজের বাড়ি পালাই...যা আমায় ডাকছে... আয় আয় আয়। 


দুনিয়া কহেতা মুঝকো পাগল, ম্যায় কহেতা দুনিয়া কো পাগল - বলতেন তিনি। সত্যিই সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত, তামাম সঙ্গীত দুনিয়া, আসমুদ্র হিমাচল, সঙ্গীতপ্রেমী বিশ্ব পাগলের মতোই ভালবাসে তাঁকে। কেউ তাঁকে অলভিদা জানায়নি।