নয়াদিল্লি: 'সম্পূর্ণ প্যাকেজ' (total package)। কিশোর কুমার (Kishore Kumar) সম্পর্কে সকলে একবাক্যে এই বিশেষণ মেনে নেবে। গান, অভিনয়, পরিচালনা এমনকী প্রযোজনাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আর এমন প্রতিভাবান মানুষ কেন দর্শকের প্রিয় পাত্র হবেন না?


প্রতিভা তাঁর অনায়াস, প্রাণবন্ত গানের গলা, তিনি আদতে হিন্দি চলচ্চিত্রে একটি সম্পূর্ণ বিনোদন প্যাকেজ ছিলেন। একাধারে এক দক্ষ অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং অনস্ক্রিন-অফস্ক্রিনে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি, তাঁর উন্মাদনা, মাতিয়ে রাখার ক্ষমতা।


'প্যাকেজ' কিশোর কুমার


'খোয়াব  হো তুম ইয়া কোই হকিকত' থেকে 'পল পল দিল কে পাস', 'জিন্দেগি কে সফর মে' থেকে 'খাইকে পান বনারসওয়ালা' বা 'খিলতে হ্যায় গুল ইয়াহা' থেকে 'কেয়া ইয়েহি পেয়ার হ্যায়', এমন কোনও অনুভূতি নেই যার জন্য কিশোর কুমারের কণ্ঠে কোনও কালজয়ী গান পাওয়া যাবে না। দেব আনন্দ থেকে ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খন্না থেকে অমিতাভ বচ্চন, শশী কপূর থেকে সঞ্জয় দত্ত, বিভিন্ন ধরনের অভিনেতার কণ্ঠে একাধিক প্রকারের সুপারহিট গান গেয়েছেন সুরের জাদুকর।


পর্দার সামনে সুরের জাদুকর


কিন্তু শুধু যে নেপথ্য কণ্ঠই নয়। তিনি দর্শকদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন পর্দার সামনে অভিনয় করেও। রোম্যান্টিক চরিত্র থেকে জটিল মানসিকতার চরিত্র, সব ধরনের গানের মতো সাবলীল ছিলেন যে কোনও ধরনের চরিত্রে। 


১৯২৯ সালের ৪ অগাস্ট জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি তারকা শিল্পীর গাওয়া একাধিক গান থেকে শ্রোতারা নিশ্চয়ই নিজেদের পছন্দের তালিকা তৈরি করেন। কিন্তু যদি তাঁর অভিনীত চরিত্রের কথা বলা হয় তাহলে প্রথমেই মাথায় আসে 'চলতি কা নাম গাড়ি' (১৯৫৮), যেখানে তাঁর দুই ভাই অশোক, অনূপের সঙ্গে দেখা যায় তাঁকে। বা মনে আসে তাঁর 'পান প্রেমী' চরিত্রের কথা 'পড়োসন' (১৯৬৮) ছবিতে।


কিন্তু একজন অভিনেতা হিসেবে আরও অজস্র দুর্দান্ত কাজ করেছেন কিশোর কুমার। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে পাল্লা দিয়ে এক ছবিতে কাজ করেছেন দিলীপ কুমার, মীনা কুমারী এমনকী জয়াললিতার সঙ্গেও। অনুপ্রাণিত করেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। 


প্রায় ১২০০টি মতো ছবির জন্য অন্তত ৩০০০টি গান গাওয়ার পাশাপাশি ১৯৪৬ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে প্রায় ৯০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন কিশোর কুমার। 


কিন্তু এই ছবির বেশিরভাগই ১৯৭০ সালের পূর্বে মুক্তি পায় এবং বিশেষ ভাল ফল করতে পারেনি বক্স অফিসে। এছাড়া তিনি এরপর বিশেষ অভিনয়ও করেননি। শোনা যায়, খুবই 'দুষ্টু' ছিলেন কিশোর কুমার। তিনি নাকি বাড়ির পরিচারকদের  বলে রাখতেন ছবি নির্মাতারা বাড়িতে এলে তাঁদের চলে যেতে বলতে, পারিশ্রমিক দেওয়ার সময় তাঁদের হাত কামড়াতে। এমনকী অনেক সময় কাজে হঠাৎ অনুপস্থিতও হতেন তিনি। একবার, একজন পরিচালক তাঁকে কাজে উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে আদালত থেকে একটি ডিক্রি পেয়েছিলেন, তখন নির্দেশানুসারে প্রত্যেকটা কাজ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন তিনি। 


আজ বরং দেখা যাক, কিশোর কুমারের এমন কিছু ছবির কাজ, যা হয়তো বক্স অফিসে সাফল্য পেয়েছিল, বা পায়নি, বা কেউ হয়তো মনেই রাখেনি, সময়ের নিয়মে হারিয়ে গেছে।


নৌকরি (১৯৫৪): বিমল রায় পরিচালিত সিনেমাটি স্বাধীনতার প্রথম দশকে ভারতীয় তরুণদের স্বপ্নকে চিত্রিত করতে চেয়েছিল। রতন হিসাবে, যে একটি স্থির চাকরির স্বপ্ন দেখে, যাতে সে তার বিধবা মাকে একটি ভাল বাড়িতে রাখতে পারে, অসুস্থ বোনের চিকিৎসা করাতে পারে, কিশোর কুমার আশাবাদী, হতাশ, হৃদয়বিদারক, একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক হিসাবে একটি দক্ষ অভিনয় করেন।


নিউ দিল্লি (১৯৫৬): এটিও ছিল নতুন ভারতকে, তার বিস্তৃত বৈচিত্র্যের মাধ্যমে এবং কিছু সমসাময়িক অনুরণন সহ দেখার ছবি। কিশোর কুমার পাঞ্জাবি যুবক আনন্দের চরিত্রে অভিনয় করেছেন যে রাজধানীতে এসে বাড়ি পাচ্ছে না কারণ বাড়িওয়ালারা নিজেদের অঞ্চলের কোনও ভাড়াটে খুঁজছেন। এরপর সে এক তামিলের ছদ্মবেশ নেয়, কিন্তু তার জীবনে প্রেমিকার প্রবেশের পরই সমস্যা আরও দানা বাঁধে।


মুসাফির (১৯৫৭): পরিচালক হিসেবে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি। এখানে এক বাড়ির তিন ধরনের ভাড়াটের মাধ্যমে এক জীবনযুদ্ধের গল্প বলা হয়। সেখানেই এক ভাড়াটে পরিবারের বেকার ছেলের চরিত্রে ছিলেন কিশোর কুমার।


দিল্লি কা ঠাগ (১৯৫৮): কিশোর কুমারের বিপরীতে দেখা যায় নূতনকে। এটি ছিল কিশোর কুমারের জন্য তার অদ্ভুত ঐতিহাসিকতা প্রদর্শনের আরেকটি ছবি। একটি সঠিক চাকরি পাওয়ার জন্য তাঁর মাকে প্ররোচিত করে, কিশোর কুমার শর্মা (আমাদের নায়ক) মুম্বই যায় এবং আশা (নূতন)-এর প্রেমে পড়ে। মেয়েটির কাকা নকল ওষুধ তৈরির কারখানা চালায় এবং কিশোর কুমারের জীবনে একটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং তাঁকে টার্গেট করে ফেলে। এই ছবির বিখ্যাত গান 'সি এ টি ক্যাট, ক্যাট মানে বিল্লি'।


আরও পড়ুন: Kishore Kumar Birthday: চর্চা কম হলেও হৃদয় ছুঁতে পারে কিশোর কুমারের এই গানগুলি


আপনা হাত জগন্নাথ (১৯৬০): মদন নামের এক চরিত্রে দেখা যায় কিশোর কুমারকে। তাঁর চরিত্র মজা করতে পছন্দ করে এমন এক ছাত্র, যার ওপর ইতিমধ্যেই বাবা-মা অনেক বিনিয়োগ করে ফেলেছে। কিন্তু সে যখন যোগ্য একটা চাকরি পেতে বিফল হয় তখন স্বপ্ন ভাঙতে থাকে।


হাফ টিকিট (১৯৬২): কোটিপতির ছেলে। ঝামেলার পর বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এই চরিত্রে কিশোর কুমার। অর্থের অভাবে, রেলের টিকিটে ছাড় পেতে একজন নাবালকের ছদ্মবেশ করে কিন্তু একজন বুদ্ধিমান হীরা পাচারকারীর ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে। 'চিল চিল চিল্লাকে কজরী সুনায়' এই ছবির অত্যন্ত জনপ্রিয় গান, যেখানে শিশুকণ্ঠও কিশোর কুমারের। 


দূর গগন কি ছাও মে (১৯৬৪): কিশোর কুমার পরিচালিত প্রথম ছবি। এখানে সেনার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি যে বাড়ি ফিরে দেখে আগুন লেগে তার গোটা পরিবার মারা গেছে। একমাত্র বেঁচে রয়েছে তার ছেলে যে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর থেকে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। বাবা-ছেলের অদ্ভূত সুন্দর সম্পর্কের গল্প বলে এই ছবি। 


মিস্টার এক্স ইন বম্বে (১৯৬৪): ভারতীয় সিনেমার প্রথম দিকের ছবির। কল্পবিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এখানে কিশোর কুমার বেনারসের এক কবি, যে মুম্বই এসে পাশ্চাত্যের ঢঙে নিজেকে বদলে ফেলে এবং প্রেমে পড়ে। কিন্তু তাঁর প্রেমিকার বিজ্ঞানী বাবার তৈরি করা সিরাম থেকে শুরু হয় গণ্ডগোল।


পেয়ার কিয়ে যা (১৯৬৬): দক্ষিণী ছবির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। মেহমুদ ও ওম প্রকাশের মধ্যে কমিক সেটের জন্য বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু সেই ছবিতে নজর করার মতো অভিনয় করেছিলেন কিশোর কুমার। তাঁর চরিত্র থেকে পরে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয় ১৯৯৯ সালের 'হসিনা মান যায়গি' ছবিতে গোবিন্দার চরিত্র।


দো দুনি চার (১৯৬৮): শেক্সপিয়রের 'কমেডি অফ এররস'-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া ছাড়া এই ছবি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। গুলজারের লেখা একেবারে প্রথমদিকের কাজের মধ্যে অন্যতম এই ছবি। তবে এই ছবিতে কিশোর কুমার তাঁর অন্যধারার গান নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম 'হাওয়াও পে লিখ দো, হাওয়াও কে নাম।'