কলকাতা: মাত্র কয়েকদিন আগেই যখন কলকাতায় পা রেখেছিলেন তিনি, তখন তাঁর মুখে চিরপরিচিত সেই হাসিটা লেগে। কত পরিকল্পনা, রিহার্সাল.. লক্ষ্য একটাই, দর্শকদের মন জয়। দীর্ঘ অনুশীলন, গানের তালিকা.. তারপর মঞ্চে উঠলেন কে কে। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল কলকাতার নজরুল মঞ্চ। দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠান, একের পর এক ২০টা গান.. জনতা ভাবতে পারেননি, মঞ্চ আর দর্শকদের মনে রাজ করছেন যিনি, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি থাকবেন না? সুরলোকে হারিয়ে গেলেন কে কে (Krishnakumar Kunnath)। হঠাৎ। আকস্মিক। পড়ে রইল অসমাপ্ত জীবন আর অনেক প্রশ্ন। অবহেলা? বিশৃঙ্খলা? রাজনীতি? উত্তর নেই এখনও। ঠিক কী হয়ে গেল গত ২ দিনে? 


 


নজরুল মঞ্চের 'বিশৃঙ্খলা'


৩০ এবং ৩১, এই দুই দিন কলকাতায় অনুষ্ঠান ছিল কে কে-র। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান ছিল নজরুল মঞ্চে। আয়োজন করেছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। গুরুদাস কলেজের ফেস্টে আমন্ত্রিত ছিলেন কে কে। গুরুদাস মঞ্চে বসবার জায়গা ২০০০ থেকে ২৫০০০ মানুষের। ১ তারিখ কে কে-র অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন প্রায় ৭০০০ মানুষ। এও অভিযোগ, ভিড় ঠেকাতে অগ্নি নির্বাপণ স্প্রে করা হয়। কাজ হয়নি। ভেঙে যায় ভিআইপি গেটের দরজা। কে কে দেখার উচ্ছাসে 'টিকিট নেই' পোস্টার মানেননি দর্শকেরা। পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেন অনেকেই। এদিকে বদ্ধ নজরুল মঞ্চে ততক্ষণে গরম বাড়ছে। মঞ্চে কে কে গান গাইতে গাইতে বার বার ঘাম মুছছিলেন, দর্শকদের কিছুটা মজা করেই দেখাচ্ছিলেন ঘামে ভেজা টি শার্ট। জল খাচ্ছিলেন বার বার, বিরতিতে বিশ্রামও নেন ব্য়াকস্টেজে গিয়ে। বার বার বলেন এসি কাজ করছে না, বলেছিলেন স্পটলাইট নিভিয়ে দিতে। শোনা হয়নি সেই কথা। অডিটোরিয়ামে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই। শেষ গান গেয়েছিলেন, হাম রহে ইয়া না রহে কাল.. কাল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল..'। গান শেষ করে যখন নিরাপত্তার বলয়ে নজরুল মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন কে কে, তখন কিছুটা অসুস্থ বোধ করছিলেন তিনি। কিন্তু তখনও তাঁর হাজার হাজার অনুরাগী ভাবতে পারেননি, তাঁর বিখ্যাত গানের কথাগুলো এমন নির্মমভাবে সত্যি হয়ে যাবে। নিজেও কী ভাবতে পেরেছিলেন কে কে? 


 


হোটেলের পথেই অসুস্থ


নজরুল মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে যেতে যেতেই বেশ অসুস্থবোধ করছিলেন সঙ্গীতশিল্পী। গাড়িতে যেতে যেতে বলেছিলেন, 'শীত করছে'। নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল গাড়ির এসি। হাতে পায়ে ক্র্যাম্প ধরছিল কে কে-র। কিন্তু তবুও চিকিৎসকদের কাছে না গিয়ে গ্র্যান্ড হোটেলেই ফেরেন কে কে। সেখানে পৌঁছে কয়েকজন অনুরাগীর সঙ্গে সেলফির আবদারও মেটান কে কে। তারপর লিফটে করে নিজের ঘরে যান। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, লিফটেই মাথা ঝুঁকে পড়েছিল কে কে-র। লবি দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যান কে কে। কিন্তু এরপর? কে কে-র সঙ্গীর দাবি, ঘরে ঢুকে সোফায় বসতে গিয়ে পড়ে যান কে কে। মাথা ঠুকে যায় তাঁর। তখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় সঙ্গীতশিল্পীকে। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স কই? হোটেলে তখন মজুত ছিল না অ্যাম্বুল্যান্স। অগত্যা গাড়ি করে সিএমআরআই-তে নিয়ে যাওয়া হয় কে কে-কে। 


 


আরও পড়ুন: Swastika on KK: 'কারও উত্তর দেওয়ার কোনও দায় নেই!' কেকে-র মৃত্যুতে লিখছেন স্বস্তিকা


 


হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ 


হাসপাতাল অবধি পৌঁছে আর সুস্থ হওয়া হল না কে কে-র। সঙ্গীতশিল্পী যখন সিএমআরআই-তে পৌঁছলেন, তখন তাঁর শরীরে আর প্রাণ নেই। চিকিৎসকরা জানিয়ে দিলেন, আর কিছু করার নেই। বিদ্যুৎতের বেগে ছড়িয়ে পড়ল খবর। কে কে নেই! সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়, সংবাদমাধ্যম জুড়ে শুধুই কে কে-র প্রয়াণের খবর। রাত জাগল মানুষ, নজরুল মঞ্চে সেদিন ঠিক কী কী হয়েছিল, চলল আলোচনা, সমালোচনার কাটাছেঁড়া। নিউ মার্কেট থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করা হয়। 


 


গান স্যালুটে কে কে-কে বিদায় কলকাতার


১ তারিখ সারা রাত সিএমআরআইতেই রাখা থাকে সঙ্গীতশিল্পীর মরদেহ। পরেরদিন সকালে কলকাতা এসে পৌঁছন কে কে-র স্ত্রী আর ছেলে মেয়ে। বিমানবন্দর থেকেই তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় সিএমআরআই হাসপাতালে। তারপর চলে পোস্টমর্টেম। পোস্টমর্টেমের পরে কে কে-র দেহ নিয়ে আসা হয় রবীন্দ্রসদন চত্বরে। উপস্থিত ছিলেন কে কে-র পরিবার থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ রাজ্যের বিশিষ্টরা। গান স্যালুটে প্রিয় গায়ককে শেষ সম্মান দেয় কলকাতা। 


 


আরও পড়ুন: Soumitra Khan on KK death: ৬ দফা প্রশ্ন তুলে শাহকে চিঠি, কে কে-র মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে তদন্তের দাবি সৌমিত্র-র


 


পার্ক প্লাজায় শেষবার কে কে


বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ কফিনবন্দি কে কে-র দেহ নিয়ে মুম্বই উড়ে যায় পরিবার। শেষবারের মতো পার্ক প্লাজায় যান কে কে। তাঁর বাসস্থানে। যে বাড়িতে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পরিবারের সঙ্গে কত আনন্দের মুহূর্ত কাটিয়েছেন তিনি, শেষবারের মতো সেখানেই ফিরলেন কে কে। কেবল কফিনবন্দি হয়ে। সারা রাত সেই আবাসনেই ছিল কে কে-র মরদেহ।


 


আলবিদা!


আজ বেলার দিকে মুম্বইয়ের ভারসোভার শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় কে কে-র। উপস্থিত ছিলেন কে কে-র অজস্র অনুরাগী থেকে শুরু করে মুম্বইয়ের বহু শিল্পী। ফুলে মোড়া কে কে-র দেহকে শেষবারের মতো বিদায় জানানো হয় গানে গানে। মোমবাতি হাতে অনুরাগীদের সুরে, চোখের জলে, আবেগে মিশে গেলেন কে কে। মনে রয়ে গেল তাঁর হাসি লেগে থাকা মুখ আর এক সুরেলা রূপকথা। কে কে যত্নে রয়ে গেলেন হাজার হাজার মানুষের মনের মণিকোঠায়।