পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা: ‘মিমি’ - এক মায়ের কাহিনি। নেটফ্লিক্স এবং জিও সিনেমায় মুক্তি পেয়েছে কৃতি শ্যানন, পঙ্কজ ত্রিপাঠি অভিনীত ছবি ‘মিমি’। ছবিটিতে মিমির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কৃতী শ্যানন। ড্রাইভার ভানুপ্রতাপ পাণ্ডের ভূমিকায় রয়েছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী। মিমির বান্ধবী শমার চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাই তমহানকর। মিমির মা শোভা রাঠৌরের চরিত্রে সুপ্রিয়া পাঠক এবং বাবা মানসিং রাঠৌরের ভূমিকায় মনোজ পহওয়া অভিনয় করেছেন। এছাড়াও মার্কিন দম্পতি সামের এবং জনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইভলিন এডওয়ার্ডস এবং এইডন হোয়াইটক। ছবিটি পরিচালনা করেছেন লক্ষণ উতেকার।
সারোগেসিকে কেন্দ্র করে এই ছবির চিত্রনাট্য লেখা হলেও আদতে সন্তানকে বড় করে তোলার জন্য একজন সিঙ্গল মাদারের নিরন্তর লড়াই এই ছবির ইন্ধন হয়ে উঠেছে। দু’ঘন্টা ১৩ মিনিটের ছবি 'মিমি'। ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে কী ঘটবে সেই উত্তেজনাটা প্রথম থেকেই ছবিতে বুনেছেন পরিচালক। কিন্তু বাস্তবে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে দেখা যায়, চেনা বলিউডি ফর্মুলা পরিচালক এড়িয়ে যেতে পারেননি। মিমির বান্ধবী শমার সেই সংলাপটি যেন কাহিনির পরিসমাপ্তিকে এককথায় ব্যক্ত করে- ‘হাম যো সোচতে হ্যায়, ওহ জিন্দেগি নেহি হোতি, যো হামারে সাথ হোতা হ্যায় ওহ জিন্দেগি হোতি হ্যায়।’ অর্থাৎ, আমরা যা ভাবি জীবন তা নয়, আমাদের সঙ্গে যা ঘটে সেটাই জীবন।
'মিমি' ছবির কাহিনি শুরু হয় রাজস্থানের এক ছোট্ট শহরে। ২৫ বছরের তরুণী মিমির ইচ্ছে সে বলিউডে গিয়ে হিরোইন হবে। নিজের স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছে সে। রাজস্থানের বিভিন্ন হোটেলে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য সে নৃত্য পরিবেশন করে। এদিকে আমেরিকা থেকে ভারতে সারোগেট মাদারের সন্ধানে এসেছে সামের আর জন। সামেরের পক্ষে গর্ভধারণ সম্ভব নয়। তাই সুস্থ-সবল একজন সারোগেট মাদারের খোঁজে রাজস্থানে এসে পৌঁছেছে তাঁরা। ঘটনাচক্রে তাঁদের গাড়ির ড্রাইভার ভানুপ্রতাপ পুরো বিষয়টি জানতে পারে। সামের আর জন তাঁকে জানায়, একজন সারোগেট মাদারের সন্ধান দিতে পারলে পাঁচ লক্ষ টাকা পাবে সে। মিমির নাচের অনুষ্ঠান দেখে তাকে মনে ধরে যায় মার্কিন দম্পতির। মিমিরও অনেক টাকার প্রয়োজন। ভানুপ্রতাপের কথায় শেষপর্যন্ত রাজি হয়ে যায় মিমি।
সারোগেট মাদার হওয়ার কঠিন লড়াইয়ের মাঝে ভানু কিন্তু মিমিকে ছেড়ে চলে যায়নি। সে মিমির সঙ্গেই রয়ে যায়। সংলাপের মুনশিয়ানায়, মিমির সঙ্গে ভানুর রয়ে যাওয়ার দারুন একটা যুক্তিও রয়েছে এই ছবিতে। মিমি যখন ভানুকে জিজ্ঞেস করে, সে কেন মিমির সঙ্গে রয়ে গিয়েছে, তখন ভানু বলে ওঠে ড্রাইভারদের নীতিই হল গাড়িতে সওয়ারি তুলে ফেললে তাঁকে যেভাবেই হোক গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। মিমিকেও তাই মাঝপথে ফেলে রেখে চলে যেতে রাজি নয় সে। এভাবেই একজন মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচয় নিয়ে মিমির সঙ্গে রয়ে যায় ভানু। ভানুর পরিবার আছে। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে বাড়িতে মিমি ভানুকে নিজের স্বামী হিসেবে পরিচয় দেয়। পরিস্থিতির চাপে ভানুও সেই পরিচয় নিয়েই মিমির সন্তানের জন্মের অপেক্ষায় থাকে। ছবির শেষ পর্বে মাতৃত্বের দাবি নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায় দু’জন মা। সন্তানের গায়ের রং দিয়ে মায়ের ভালবাসার বিচার যে করা যায় না, সে কথা বলে মিমির কাহিনি। পাশাপাশি বলে, গর্ভধারণ না করেও একজন নারী মায়ের স্নেহ-ভালবাসায় ভরিয়ে দিতে পারেন সন্তানকে। ভ্রুণ হত্যার বিরুদ্ধেও এক তীব্র প্রতিবাদ রয়েছে মিমির কাহিনিতে। এরই সঙ্গে মিমির বান্ধবী শমা এবং মিমির বাবার খুদে শিষ্যর পারিবারিক অন্তরঙ্গতার প্রেক্ষাপটে দুই সম্প্রদায়ের সহাবস্থান, সম্প্রীতির ছবিও ধরা পড়েছে।
পরিচালক লক্ষণ উতেকারের সঙ্গে এই ছবির কাহিনি লিখেছেন রোহন শঙ্কর। ছবির সংলাপও তাঁরই লেখা। বলতেই হয়, ‘মিমি’-র কাহিনি এবং সংলাপ যোগ্য সঙ্গত করেছে। তবে এই কমেডি ড্রামা অতিনাটকীয়তা বর্জন করতে পারেনি এই ছবি। মিমির সন্তান হিসেবে এক শ্বেতাঙ্গ শিশুকে যেভাবে পরিবারের সকলে মেনে নিল, তা বাস্তবসম্মত নয়। পাশাপাশি চিকিৎসকের চরিত্রে জয়া ভট্টাচার্যের সংলাপের মধ্যে দিয়ে সারোগেসির তথ্যগত যে গভীরতা ছোঁওয়া প্রয়োজন ছিল, তা এই ছবিতে অনুপস্থিত। এক মার্কিন দম্পতি সন্তানের জন্য ভারতে এসে কেন সারোগেট মাদার খুঁজছেন তা কোনও ভাবেই বোধগম্য হয় না। অন্যদিকে ক্লাইম্যাক্সেও প্রবল বলিউডি নাটকীয়তা পরিবেশন করা হয়েছে।
এ আর রহমান এই ছবির সঙ্গীতপরিচালক। ছবির গানগুলি অবশ্য কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই ব্যবহার করা হয়েছে। অহেতুক গানের দৃশ্যের অবতারনা হয়নি। মিমির চরিত্রে কৃতী শ্যাননের অভিনয় এই ছবির সম্পদ। লক্ষণ উতেকারের আগের ছবি ‘লুকাছুপি’-তেও কৃতী অভিনয় করেছিলেন মুখ্য চরিত্রে। ‘মিমি’-তে পঙ্কজ ত্রিপাঠীর অভিনয় নিয়ে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। সংলাপ, অভিব্যক্তি, কমেডি টাইমিংয়ে পঙ্কজ অনবদ্য। ভানুর চরিত্রের প্রতিটি পরত যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পঙ্কজ, তা শিক্ষনীয়। মিমির মায়ের চরিত্রে সুপ্রিয়া পাঠক এবং বান্ধবী শমার চরিত্রে সাই তমহানকরের অভিনয়ও নজরকাড়া। ছবির কিছু কিছু জায়গায় মেকআপ এবং বলিউডি ঘরানার অনাবশ্যক মশলার প্রয়োগ ছন্দপতন ঘটিয়েছে।
তবে সামগ্রিক ভাবে ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া জাতীয় পুরস্কারজয়ী মরাঠী ছবি ‘মালা আই ভায়িচে’-র হিন্দি রিমেক ‘মিমি’ বিনোদনের অঙ্কে দর্শকদের হতাশ করবে না।