পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা: মধ্যবিত্ত ছাপোষা জীবনের মধ্যে কত মিষ্টতা থাকতে পারে, সেটাই তুলে ধরেছে ‘গুল্লক সিজন থ্রি’-র (Gullak Season 3) কাহিনি। সোনি লিভে মুক্তি পেয়েছে জনপ্রিয় এই সিরিজটির তৃতীয় সিজন। প্রথম দু’টি সিজনের মতোই তৃতীয় সিজনও তেমনই আকর্ষক। ছোট ছোট পর্বের সিরিজটি জুড়ে সেই অনাবিল মুগ্ধতা। কেন দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছে এই সিরিজটি, তার উত্তর দিতে গিয়ে টিম গুল্লকের সবাই একবাক্যে বলছেন ‘এই সিরিজ হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছবিগুলোর পটভূমি মনে করিয়ে দেয়। কোথাও যেন ফিরে আসে সেই নস্ট্যালজিয়া।’


'গুল্লক সিজন থ্রি' প্রেক্ষাপট-


গুল্লকের অর্থ হল মাটির ভাঁড়। যে ভাঁড়ে একটু একটু অর্থ সঞ্চয় করে মধ্যবিত্ত। কিন্তু টাকাই শুধু নয়। ভালবাসা, বিশ্বাস আর দায়িত্ব বোধও তো সঞ্চিত হয়। বিপদে-আপদে যে সঞ্চয় ভাঙিয়ে এগিয়ে চলে পরিবার। গুল্লক থ্রি-র কাহিনি শুরু হয়েছে মিশ্র পরিবারের রোজনামচা থেকেই। পরিবারের কর্তা সন্তোষ মিশ্র। তিনি বিদ্যুৎ দফতরের কর্মী। নির্ভেজাল এক মানুষ। কোনও সাতে পাঁচে থাকতে পছন্দ করেন না। অফিসে রাজনৈতিক ইউনিয়ন এড়িয়ে চলেন। বাড়িতে রয়েছে তাঁর দুই ছেলে অন্নু মিশ্র আর আমন মিশ্র, এবং তাঁর স্ত্রী শান্তি মিশ্র। অন্নু মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি পেয়েছে সদ্য। মাইনে তার সতেরো হাজার। প্রথম মাসের মাইনে দিয়েই সাত হাতার টাকার একটি জুতো কেনার স্বপ্ন তাঁর চোখে। উল্টোদিকে অন্নুর ছোটভাই আমন সবে একাদশ শ্রেণীতে পা রেখেছে। পড়ার বই বাদে তার একটি জিনিসই প্রিয়। নিজের চুল। স্টাইলিশ চুল রেখে তাঁতে বার্গেন্ডি কালার করাতে চায় সে। দাদার কাছে টাকা চেয়ে হাতও পাতে। কিন্তু সেই আশায় দাদা জল ঢেলে দেয়। মিশ্র পরিবারের দরজা পাড়া-পড়শিদের জন্য সব সময় খোলা। আর সেই দরজা দিয়েই যখন-তখন ঢুকে পড়েন তাঁদের প্রতিবেশী ‘বিট্টু কি মাম্মি’। বাড়িতে গ্যাস ফুরিয়েছে, মিশ্র গিন্নি শান্তির সামনে হাজির তিনি। গ্যাস চাই। মিশ্র পরিবারের সবাই একসঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেতে যাচ্ছেন, ব্যস ‘বিট্টু কি মাম্মি’ বিট্টুকে নিয়েই জুড়ে গেলেন তাঁদের সঙ্গে। তখন সন্তোষ মিশ্র নিজের অসন্তোষ গোপন করেই মনে মনে যেন বলেন - এই তো জীবন কালীদা। মিশ্র পরিবারে মাসের শেষে টাকার টানাটানি। বড়ছেলের মাইনে কত? সেটা জানতে আলোচোনায় বসেন কর্তা-গিন্নি। ছোট ভাইয়ের প্রতি দাদা হিসেবে তাঁর কী কী কর্তব্য তা মনে করিয়ে দেওয়া হয় অন্নুকে। সন্তোষ মিশ্রর গ্রামের বাড়ি থেকে তাঁর এক বাল্য বন্ধু নিজের মেয়েকে নিয়ে হাজির হন বাড়িতে। মেয়েটির বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে হবে সন্তোষকেই। হাসি মুখে সেই দায়িত্বও নেন তিনি। মাতৃহারা সেই মেয়েকে আপন করে নেন মিশ্র গিন্নি। পাত্র পক্ষ দেখে যাওয়ার পর বিয়েরকথা পাকা হয়। কিন্তু এরপর মেয়েটির মন পড়ে ফেলেন শান্তি। বুঝে যান, সেই ছেলেটিকে বিয়ে করতে চাইছে না মেয়েটি। স্বামীকে বুঝিয়ে সেই বিয়ে ভেঙে দেন তিনি। ছোটবেলায় মাতৃহারা সেই তরুণী শান্তির মধ্যেই যেন খুঁজে পায় নিজের মাকে। এরপর নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকে কাহিনি। হঠাৎ ছন্দপতন হয় সন্তোষ মিশ্রর হার্ট অ্যাটাকে। পরিবারে দায়িত্ব এবার কে সামলাবে? মুহূর্তে পাল্টে যায় অন্নুর চরিত্র। বাড়িতে সে বড়ছেলে। অতএব এবার সব দায়িত্ব তাঁর। ছোটভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে সে বলে ‘হাম বড়ে হ্যায়, সব সম্ভাল লেঙ্গে।’ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে সন্তোষ মিশ্র জানতে চান হাসপাতালের এত খরচ কে মেটালো? অন্নু অবলীলায় বলে মেয়নে পেয়সে নেহি কামায়ে লেকিন ইনসান কামায়ে হ্যায়। নিজের অল্পদিনের কর্মজীবনে সে টাকা হয়তো কামায়নি, কিন্তু আস্থাভাজন অনেক মানুষকে সে পেয়েছে নিজের সঙ্গে। 


আরও পড়ুন - 'Mai' Review: দুর্ঘটনা নাকি হত্যা? সন্তানের মৃত্যুতে মায়ের প্রতিশোধের গল্প 'মাই'


পারিবারিক সম্পর্কের সিগ্ধ উষ্ণতায় ভরপুর এই সিরিজের। সন্তোষ মিশ্রের ভূমিকায় জামিল খানের অভিনয় অনবদ্য, অতুলনীয়। তেমনই পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন গীতাঞ্জলি কুলকার্নি। শান্তির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। অন্নুর চরিত্রে নজর কেড়েছেন বৈভব রাজ গুপ্ত। আমানের চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন হর্ষ মায়ার। ‘বিট্টু কি মাম্মি’র ভূমিকায় সুনীতা রাজওয়াড়ের অভিনয় অনবদ্য। সব মিলিয়ে গুল্লাক সিজন থ্রি এক অনাবিল আনন্দ দিয়ে যায় দর্শকদের। পরিচালক পলাশ ভাসওয়ানি যে কুশলতায় সিরিজটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, তাতে কোনও অংশ এতটুকুও ছন্দ কাটেনি। আর এই সিরিজের কাহিনি যিনি লিখেছেন, সেই দুর্গেশ সিংয়ের প্রশংসা তো করতেই হবে। গুল্লকে এভাবেই আরও ভালবাসা জমুক। জমুক আরও নতুন কাহিনি।