পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা : ‘দশভী’। মানে মাধ্যমিক। জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরনোর পরেই নিজের পছন্দমতো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ মেলে। তাই বলাই যায়, ‘দশভী’ হল স্বপ্নের উড়ানের রানওয়ে। আর এই রানওয়ে দিয়েই নতুন উড়ানের স্বপ্ন সার্থক করেছেন গঙ্গারাম চৌধুরী। তুষার জালোটার ছবি ‘দশভী’-র মুখ্য চরিত্র গঙ্গারাম। আর এই গঙ্গারামের ভূমিকাতেই অভিনয় করেছেন অভিষেক বচ্চন।
 
নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটির খুব স্পষ্ট একটা বার্তা আছে। যে বার্তা দেওয়া হয়েছে এক্কেবারে ছবিটির শেষে, নেলসন ম্যান্ডেলার উক্তি উদ্ধৃত করে। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘শিক্ষাই হল সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা দিয়ে দুনিয়া বদলে ফেলা সম্ভব।’ দেরিতে হলেও এই জীবনের একটা পর্যায়ে এসে এই উক্তির গভীরতা উপলব্ধি করেন গঙ্গারাম।


‘দশভী’র কাহিনি শুরু হয়েছে হরিৎ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গঙ্গারাম চৌধুরীকে ঘিরে। তাঁর প্রবল-প্রতিপত্তি, ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধি, বিশাল সম্পত্তি...সবই আছে। শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি ক্লাস এইট পাস। গঙ্গারামের স্ত্রী বিমলা সংসারের সব দায়িত্ব সামলান। কিন্তু তিনি স্বামীর সামনে জোরে কথা বলতে পারেন না। গঙ্গারামের কাছে যখন বিনিয়োগকারীরা আসেন, তখন গঙ্গারাম স্কুল গড়ার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন শপিং মল গড়ায়। তাঁর ধারণা, শপিং মল হলে রোজগারের সুযোগ মিলবে, স্কুল খুললে বাড়বে বেকারের সংখ্যা। এহেন গঙ্গারামের জীবনেই একদিন বিপর্যয় নেমে আসে। দুর্নীতির মামলায় জেলে যেতে হয় তাঁকে। তখন গঙ্গারাম মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে দেন তাঁর স্ত্রী বিমলাকে। এরপরই ধীরে ধীরে কাহিনির মোড় ঘুরতে থাকে। জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে আসেন জ্যোতি দেশোয়াল। তাঁর কড়া শাসনে বদলে যায় জেলের ঢিলে-ঢালা নিয়মকানুন। সাধারণ অপরাধীদের মতোই দিন কাটাতে হয় গঙ্গারামকে। জেলে যাতে তাঁকে কোনও কাজ করতে না হয়, তাই মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবেন বলে স্থির করেন তিনি। লাইব্রেরিতে পড়তেও যান। কিন্তু তাঁর পড়ার পিছনের মূল উদ্দেশ্যটা ধরা পড়ে যায় জ্যোতির চোখে। এরপর নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে কাহিনি এগোয়। কুর্সির স্বাদ পেয়ে ভোল বদলে যায় গঙ্গারামের স্ত্রী বিমলারও। এদিকে গঙ্গারাম শপথ করেন, মাধ্যমিকে পাস করতে না পারলে তিনি আর কোনও দিনও মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসবেন না। এখান থেকেই শুরু হয় গঙ্গারামের নতুন সফর। 


বলতেই হয় সব চরিত্র ছাপিয়ে ‘দশভী’-তে একটিই চরিত্র। গঙ্গারাম চৌধুরী। একার কাঁধেই পুরো ছবিটি টেনেছেন অভিষেক বচ্চন। সুপারিন্টেন্ডেন্ট জ্যোতি দেশোয়ালের চরিত্রে কিছু কিছু দৃশ্যে ইয়ামী গৌতমের অভিনয় সংবেদনশীল হলেও ছবিটির আর কোনও চরিত্রই মনে দাগ কাটতে পারে না। গঙ্গারামকে যে বাবে হিন্দি অক্ষর চেনান ইয়ামী, তাতে ‘তারে জমিন পর’-এর ঈশান অবস্থির কথা মনে পড়বেই পড়বে। গঙ্গারামের স্ত্রী বিমলার চরিত্রে নিমরত কৌরের অভিনয় কোথাও কোথাও আরোপিত মনে হয়। তাঁর চরিত্রটি অবধারিত ভাবে ‘মহারানি’-তে হুমা কুরেশি অভিনীত চরিত্রটির কথা মনে পড়ায়। কিন্তু হুমার অভিনয়ে মহারানি যতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, নিমরতের অভিনয়ে বিমলা ততটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। সচিন-জিগরের সুরে ছবির গানগুলিও মনে রয়ে যাওয়ার মতো নয়। চিত্রনাট্য কোন দিকে এগোবে তা আগে থেকেই অনুমান করা যায়। সেই অনুমানও নির্ভুল প্রমাণিত হয়। সোজা পথের সহজ অঙ্কে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছেছেন পরিচালক তুষার জালোটা। দু’ঘন্টা পাঁচ মিনিটের ছবি। কিছু কিছু অংশে কাহিনি ঢিমে তালে না এগোলে ছবিটির বাঁধন আরও মজবুত হতে পারত। রাশভারী গঙ্গারাম চৌধুরীকে জেলের ভেতরে নাচের দৃশ্যে যেভাবে ব্যবহার করেছেন পরিচালক তার কি কোনও প্রয়োজন ছিল ? হালকা  ইমোশনাল সুড়সুরিটুকু বাদ দিলে, ছবিটার শেষে গিয়ে নচিকেতার গানটা মনে পড়ে যায়- 
'আমি মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ বাবু,
কিছুই জানি না।
এই এদেশের রং-তামাশা
কিছুই বুঝি না।
আজকে যিনি কয়লামন্ত্রী ,
কালকে দেখেন শিক্ষা।
তাই কয়লা কালো শিক্ষা নিয়ে
মানুষ করে ভিক্ষা।'