কলকাতা: আলো ঝলমলে মাল্টিপ্লেক্স! সবেমাত্র শেষ হয়েছে ইভিনিং শো। হল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে কালো কালো মাথার সারি। সদ্য দেখা সিনেমার কোনও ঘটনা বা চরিত্র নিয়ে আড্ডা মারতে মারতেই চলছে খাওয়া দাওয়া। হৈ হুল্লোড় করতে করতে বাড়ির পথে ফেরা। বাঙালির জীবনের অতি পরিচিত এই ছবি ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা শুরু হয়ে গেল জোরকদমে। বাংলা সিনেমার শ্যুটিং শুরু করার জন্য একের পর এক বৈঠক চলছে আর্টিস্ট ফোরামে। টলিপাড়ার ব্যস্ত পরিচালকদের মধ্যে কারও হাতে একঝাঁক ছবির কাজ। কেউ লকডাউন পর্বের আগে বিদেশ থেকে শ্যুটিং সেরে ফিরেছেন। বাকি দেশের মাটিতে শ্যুটিং আর পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ। কেউ কেউ আবার এই অবসরে কাটাছেঁড়া শুরু করেছেন পরবর্তী সিনেমার চিত্রনাট্য নিয়ে। করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে শ্যুটিং শুরুর আগে সরকারের তরফে দেওয়া হয়েছে একগুচ্ছ নির্দেশিকা। তবে কি সিনেমা নির্মাণের ব্যাকরণটাই বদলে যাবে? সুরক্ষাবিধি মানতে গিয়ে কি আপস করতে হবে চিত্রনাট্যের সঙ্গে? কী বলছেন টালিগঞ্জের প্রথম সারির পরিচালকরা? খোঁজ নিল এবিপি আনন্দ।

  • তরুণ মজুমদার


দাদার কীর্তি থেকে শুরু করে পলাতক, আলো, ঠগিনী, তাঁর একের পর এক কালজয়ী ছবি বাঙালির মনে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে শ্যুটিংয়ের নতুন পদ্ধতি অবলম্বনের পক্ষপাতী তরুণ মজুমদার। বিখ্যাত পরিচালক বললেন, 'একদিকে যেমন শ্যুটিং শুরু করা দরকার কারণ এর সঙ্গে বহু মানুষের জীবিকার প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে, অন্যদিকে এমন একটি বুদ্ধিও বার করা দরকার যাতে সবার সঠিক সুরক্ষা বজায় রাখা সম্ভব হয়। শ্যুটিং শুরু করার আবেগে যেন সুরক্ষার দিকটা অবহেলিত না হয়।'

শ্যুটিং চালু হবার পর কেমন করে মানা হবে সামাজিক দূরত্ব? উত্তরে প্রবীণ পরিচালক বললেন,'এমন করে চিত্রনাট্য পরিকল্পনা করতে হবে যেখানে অভিনেতা অভিনেত্রীর মধ্যে পর্যাপ্ত দূরত্ব থাকবে, কিন্তু বজায় থাকবে গল্পের উত্তেজনা ও ঘটনাপ্রবাহ। এইভাবে চিত্রনাট্য সাজাতে পারলে করা যেতে পারে শ্যুটিং। করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখে শ্যুটিং-এর নতুন পরিকল্পনা করতে হবে পরিচালককেই। আমাদের সময়ে এই পরিস্থিতি কখনও হয়নি।' সুরক্ষা নিশ্চিত করেই ফের কাজ শুরু করার বার্তা দিলেন তিনি।

  • গৌতম ঘোষ


সদ্য ইতালি থেকে শ্যুটিং সেরে ফিরেছেন তিনি। বাকি মধ্যপ্রদেশ, মুম্বইয়ের শ্যুটিং। করোনা আবহে ভারতে বসেই বর্তমান পরিস্থিতিকে 'ক্যাচ ২২ সিচুয়েশন' বলেই বর্ণনা করেছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। গাইডলাইন মেনে শ্যুটিং শুরুর কথা শুনে তিনি বললেন, 'স্বাস্থ্য দফতর যে নির্দেশিকা দিয়েছে তা অবশ্যই সুরক্ষার কথা ভেবে। এবার পরিচালকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁরা কীভাবে কাজ শুরু করবেন। তবে ছোট ইউনিট নিয়ে শ্যুটিং করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে মাল্টিটাস্কিং ইউনিট নিতে হবে। অত্যধিক ভীড় জমতে দেওয়া যাবে না তারকাদের ঘিরে।'

নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আপাতত ছবি থেকে বাদ দিতে হবে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য। কিন্তু স্ক্রিপ্টের সঙ্গে আপস করতে নারাজ মনের মানুষ-এর পরিচালক। বললেন, 'প্রয়োজন হলে নায়ক-নায়িকাদের কোভিড পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে শ্যুটিং-এর আগে। পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ এলে ছবির প্রয়োজনে অন্তরঙ্গ দৃশ্যের শ্যুটিং করা যেতেই পারে।' কোভিড পরবর্তী ইন্ডাস্ট্রিতে বার বার ছবির খরচ কমানোর দিকে জোর দিলেন গৌতম। বললেন, 'সিনেমা হলে কেমন রেভিনিউ আসবে এখনও অজানা। তাই কমাতে হবে ছবির খরচ। সমস্তরকম বিলাসিতা বাদ দিতে হবে। আগে আমরা স্বাস্থ্যের প্রতি তেমন সচেতন ছিলাম না যা এখন নতুন করে মাথায় রাখতে হবে।' লকডাউনের সময়কে কাজে লাগিয়ে চলতি ছবির চিত্রনাট্য নতুন করে বিশ্লেষণে ব্যস্ত গৌতম ঘোষ।

  • শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়


একেবারে বাস্তবের মাটিতে পা রেখে সাধারণ জীবনের গল্প বলে তাঁর ছবি। আমদের রোজনামচার বিভিন্ন ঘটনা নিয়েই জীবন্ত হয়ে ওঠে বেলাশেষে, কণ্ঠ, পোস্ত, প্রাক্তন। করোনা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এবিপি আনন্দের সঙ্গে শ্যুটিং-এর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বললেন পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বললেন, 'সরকার শ্যুটিং-এর জন্য যে নির্দেশিকা দিয়েছে তা অত্যন্ত সদর্থক। কিন্তু এখনও অবধি বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলি নিয়ে পরিচালক ও প্রযোজকদের আলোচনা করতে হবে। এই পদ্ধতি অনেকটা সময় সাপেক্ষ।'

অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শ্যুটিং করাকে কম বেশি চ্যালেঞ্জিং বলেই মনে করছেন সকলে। তবে সেই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে শিবপ্রসাদের দাওয়াই 'পারস্পরিক বিশ্বাস'। বললেন, 'অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও গোটা বিষয়টা তৈরি হয় পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতার ওপর। এটা কলাকুশলী ও পরিচালকদের ওপর নির্ভর করবে তাঁরা কীভাবে বিশ্বাসের জায়গাটা তৈরি করছেন।' বর্তমান পরিস্থিতি কি ছাপ ফেলবে তাঁর পরবর্তী ছবিতে? প্রশ্ন শুনে শিবপ্রসাদ হেসে বললেন, 'ইটস টু আর্লি টু সে!'

  • রাজ চক্রবর্তী


বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে ধারাবাহিকের শ্যুটিং। হাতে বাকি রয়েছে সিনেমার কাজও। তাই সমস্তরকম সুরক্ষা নিয়েই যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্যুটিং শুরু করতে চান কমার্শিয়াল ছবির অন্যতম জনপ্রিয় পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। এবিপি আনন্দকে বললেন, 'সিনেমার শ্যুটিং নিয়ে এখনও বিভিন্ন আলোচনা চলছে। তবে শ্যুটিং শুরু হবার আগে ফ্লোর স্যানিটাইজেশন করা হবে। গোটা টিম মাস্ক, ফেস শিল্ড পরেই  কাজে নামবে।

'করোনা কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর নতুন ছবি 'ধর্মযুদ্ধ'-এর মুক্তির পথে। রিলিজ হয়নি অপর নতুন ছবি 'হাবজি গাবজি'ও। কিন্তু সিনেমা হল না খুললে ফের নতুন ছবির শ্যুটিং শুরু করতে চান না রাজ। জানালেন, পরিচালক-প্রযোজকদের মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতি ও তাকে কাটিয়ে ওঠবার উপায় বার করার জন্য আলোচনা চলছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যকে আপাতত শ্যুটিং তালিকা থেকে বাদ রাখছেন পরিচালক। বললেন, 'আপাতত নির্দেশিকা মেনেই চেষ্টা করব যাতে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের শ্যুটিং না করতে হয়। তবে মাস্ক ব্যবহার করার কোনও উপায় নেই কুশীলবদের। তাহলে ঢাকা পড়ে যাবে মুখের অভিব্যক্তি। একদিকে যেমন কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে সুরক্ষাবিধি, তেমনই শুরু করতে হবে কাজও।'

একদিকে সুরক্ষার নির্দেশিকা, অন্যদিকে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনীয়তা, জীবিকার প্রশ্ন। এই দড়ি টানাটানির মধ্যে দাঁড়িয়েই বৈঠকের পর বৈঠক করে পরিস্থিতি বাগে আনার চেষ্টা করছে টলিউড। আর সিনেমা হল-মাল্টিপ্লেক্সের সন্ধ্যেগুলো ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা করছেন সিনেপ্রমীরা।