মুম্বই: তাঁকে ছাড়া সিনেমার গান, বিশেষত হিন্দি সিনেমার (Hindi Movie Songs) সঙ্গীত পরিচালনার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। তাঁর নতুন নতুন ধরনের ইনস্ট্রুমেন্টের (instruments) 'আবিষ্কার', রোজের ব্যবহারের জিনিস থেকে শব্দ তৈরির নেশা, বছরের পর বছর ধরে মানুষকে বুঁদ করেছে। শুধু কি তাই? তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন, প্রায় বছর ২৯ আগে। কিন্তু এখনও তাঁর সৃষ্টি নতুনের মতো টাটকা। তিনি রাহুল দেব বর্মন (Rahul Dev Burman), সকলের প্রিয় পঞ্চমদা (Panchamda)। যিনি আজও তাঁর অজস্র দুর্দান্ত সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে রয়েছেন হাজার হাজার অনুরাগীর মনে, আজও যাঁর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন নতুন প্রজন্মের সঙ্গীতপ্রেমীরা, কারণ তাঁকে ছাড়া যে ভারতীয় সঙ্গীত দুনিয়া সত্যিই অসম্পূর্ণ!


বিনোদন দুনিয়ায় তিনি পঞ্চমদা নামেই পরিচিত। রাহুল দেব বর্মন, হিন্দি ছবির নেপথ্য সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একাধিক নতুন পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন। আমাদের সকলের পরিচিত, অত্যন্ত জনপ্রিয় একাধিক গানের কোনওটায় হয়তো তিনি যোগ করেছেন কাপ ও প্লেটের আওয়াজ, আবার কোথাও হয়তো মানুষের সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাস-হাসি-হাঁপানির আওয়াজকেই ব্যবহার করেছেন মিউজিক হিসেবে। এমনই নানা অদ্ভূত জিনিসের আঁতুড়ঘর রাহুল দেব বর্মন সৃষ্ট সঙ্গীতগুলি। তেমনই কিছু উদাহরণ রইল এখানে...


'মানুষ এক, কণ্ঠস্বর অনেক'


অনেকের মতে রাহুল দেব বর্মন নাকি নিজের কর্মজীবনের গোড়াতেই বুঝে গিয়েছিলেন যে হিন্দি ছবির গানের জন্য তাঁর কণ্ঠ একেবারেই মানানসই নয়। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে তাঁর গলার স্বর একেবারেই কাজে লাগাবেন না তিনি। যে গানে যখন যেভাবে প্রয়োজন পড়েছে, নিজের ভোকাল কর্ড বদলে সেই প্রয়োজন মিটিয়েছেন এবং মানুষের মন জয় করেছেন। ভয়েস মডুলেশন করে রাগী-কর্কশ স্বরটা নিজের ট্রেডমার্কই বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এর উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে, 'শোলে' ছবির 'মেহবুবা' গানটি, 'হম কিসিসে কম নহিঁ' ছবির 'তুম কেয়া জানো' গানের মেডলি অংশ, 'পুকার' ছবির 'সমন্দর মে' বা 'অপনা দেশ' ছবির 'দুনিয়া মে' গানের প্রিলিউড। 


সহজলভ্য জিনিসের ব্যবহারে বিভিন্ন শব্দের উৎপাদন


'শোলে' ছবির জনপ্রিয় গান 'মেহবুবা'। আজও শুনলে নিজের অজান্তেই শ্রোতারা যেন নেচে ওঠেন। সেই গানের জন্য বিয়ারের বোতলে ফুঁ দিয়ে এক বিশেষ রিদম তৈরি করেছিলেন তিনি। 'ইয়াদোঁ কি বারাত' ছবির গান 'চুরা লিয়া'র জন্য কাপ-প্লেটের টুংটাং শব্দকে ব্যবহার করেছিলেন গানের মিউজিকে। 


কখন কোথা থেকে কীসের সাহায্যে যে আর ডি বর্মন সুরের সৃষ্টি করে ফেলতেন, তা বোধ হয় কেউই ধরতে পারতেন না। যেমন ধরুন, তাঁর সহকারী মারুতি রাওয়ের পিঠ। তাঁর পিঠে হালকা চাপড় মেরে সেই আওয়াজ তিনি ব্যবহার করেছিলেন 'ডার্লিং ডার্লিং' ছবির 'রাত গয়ি, বাত গয়ি সমঝো' গানে। 


আমাদের আশেপাশের সমস্ত জিনিসেই যে শব্দ আছে, সবকিছুরই যে একটা তাল আছে, আর তা যে খুব সুন্দরভাবে গানের মধ্যে ব্যবহার করা যায়, তা বিস্তারিতভাবে নিজের কাজে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন পঞ্চমদা। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের যে ছন্দ, বা আমাদের হাসি-হাঁপানির যে শব্দ সেসবও নিজের গানে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করেছেন তিনি। ১৯৭২ সালে মুক্তি প্রাপ্ত 'অপনা দেশ' ছবির গান 'দুনিয়া মে লোগো কো' তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। 


রাহুল দেব বর্মনের অধিকাংশ গানেই শোনা গেছে আশা ভোঁসলের কণ্ঠ। কিন্তু তাঁর হাসিকেও গানে ব্যবহার করেন সঙ্গীত পরিচালক। ফলস্বরূপ ১৯৮৪ সালে শ্রোতারা পান 'মঞ্জিল মঞ্জিল' ছবির 'ইয়ে নয়না ইয়াদ হ্যায়' গান। 


এত পর্যন্ত পড়েই অবাক হচ্ছেন, তাহলে বলি, এখনও বাকি আছে। পঞ্চমদা 'সত্তে পে সত্তা' ছবির আবহ সঙ্গীত তৈরির জন্য গায়িকা অ্যানেট পিন্টোকে গার্গল করিয়েছিলেন। ফিরে গিয়ে একবার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরটা শুনে আসবেন না কি?


স্যান্ডপেপার ঘষে আর বাঁশের লাঠি ঠুকে, চলন্ত ট্রেনের শব্দ তৈরি করেছিলেন তিনি। গানটা মনে পড়ল? ঠিক ধরেছেন, ১৯৮১ সালে মুক্তি প্রাপ্ত 'জমানে কো দিখানা হ্যায়' ছবির 'হোগা তুমসে পেয়ারা কৌন' গানটি। 


ধাতুর তৈরি ল্যাটিন আমেরিকান স্ক্র্যাপার 'guiro' থেকে এসেছে চিরুনি ঘষার মতো আওয়াজ। গানের নাম 'মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি মে'। 


আরও পড়ুন: Clove Farming: লক্ষ্মীলাভ করতেও ভরসা উপকারী লবঙ্গ! লাভ পাবেন চাষিরা


বাদ্যযন্ত্রের মিশেল...


তবে শুধু বিভিন্ন জিনিস দিয়েই নয়, অনেকের মতে তিনিই প্রথম এমন সঙ্গীত পরিচালক যিনি সেমি-ক্লাসিক্যাল হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের সঙ্গে গিটারের টুংটাং এক করেছিলেন। ১৯৭১ সালের 'অমর প্রেম' ছবির 'রয়না বিতি যায়' গানে সন্তুর ও গিটার একসঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। আবার ওই ছবিরই 'চিঙ্গারি কোই ভড়কে' গানেও একই পদ্ধতির ব্যবহার করেন। 'মাসুম' ছবির 'তুঝসে নারাজ নেহি' গানের জন্য তিনি ১২ তারের সেমি-ইলেকট্রিক গিটার (12 strings semi-electric guitar) ব্যবহার করেছিলেন। 


'খুশবু' ছবির 'ও মাঝি রে' হোক বা 'ঘর' ছবির 'তেরে বিনা জিয়া যায় না', দুক্ষেত্রেই তবলার অন্যধরনের ব্যবহার মানুষের কাছে আনেন আর ডি। মূলত তালের বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিচিত তবলা থেকে তিনি তাল ও সুর, দুইই বের করে আনেন। যার ফলস্বরূপ দর্শক পান ওই দুই অনবদ্য সৃষ্টি। 


একবার রাহুল দেব বর্মন তাঁর সহকারী রমেশ আইয়ারকে প্লেকট্রামের বদলে কলম আর ছোট কাঠি দিয়ে গিটার বাজাতে বলেন। আবার ১৯৭৮ সালের 'শালিমার' ছবির 'ওয়ান টু চা চা চা' গানে ও 'হম কিসিসে কম নহি' ছবির 'তুম কেয়া জানো' গানের জন্য ইলেকট্রিক সেতার ব্যবহার করেছিলেন। 


এমনই অজস্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি করে গেছেন আজীবন। আর তার ফলে যে অসংখ্য অনবদ্য সৃষ্টি আমরা পেয়েছি তা বলাই বাহুল্য। ১৯৩৯ সালের ২৭ জুন, জন্ম নেন এই কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী। মৃত্যু হয় ১৯৯৪ সালে। কিন্তু এই ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েও রাহুল দেব বর্মন ওরফে পঞ্চমদা, একইভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা, প্রণাম...। 


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামেও। যুক্ত হোন


https://t.me/abpanandaofficial