কলকাতা: নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আবার পার্শ্বচরিত্রেও নজর কেড়েছেন। কিন্তু স্রোতে গা ভাসাননি কখনওই। তাই মায়ানগরীতে ‘মাচো হিরো’দের রমরমা শুরু হলেও, মিষ্টি দেখতে, প্রাণচঞ্চল প্রেমিক হিসেবেই আজও শাম্মি কপূরকে মনে রেখেছেন সকলে। অভিনয় তাঁর রক্তে ছিল, যাকে আরও প্রাণবন্ত, আরও সহজ করে তুলেছিলেন নিজে। কিন্তু প্রতিভার নিরিখে প্রাপ্তির ভাঁড়ার আক্ষরিক অর্থেই অপূর্ণ। ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন হোক বা মানুষের বিস্মৃত হওয়ার অভ্যাস,  অভিনেতা শাম্মি কপূরকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করা যায়নি বলে আজও মনে করেন তাঁর গুণমুগ্ধরা। (Shammi Kapoor Birthday)


১৯৩১ সালের ২১ অক্টোবর পৃথ্বীরাজ কপূর এবং রামশরণী মেহরা কপূরের দ্বিতীয় সন্তান, শামসের রাজ কপূর ওরফে শাম্মির জন্ম। জন্মস্থান মুম্বই হলেও, শৈশব কাটে কলকাতায়। সেই সময় কলকাতার নিউ থিয়েটার স্টুডিওজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পৃথ্বীরাজ। কলকাতার মন্টেসরি স্কুলেই প্রাথমিক শিক্ষালাভ। তার পর মুম্বই ফিরে যাওয়া। কলেজে পা রাখলেও, অল্পদিনেই সেই পাট চুকিয়ে বেরিয়ে আসেন। যোগ দেন বাবার থিয়েটার সংস্থা পৃথ্বীরাজ থিয়েটারে। ১৯৪৮ সালে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে বড়পর্দায় আত্মপ্রকাশ। মাসিক বেতন ছিল ৫০ টাকা। পরবর্তী চার বছরে তা বেড়ে ৪০০ টাকা হয়। নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ১৯৫৩ সালে, ‘জীবন জ্যোতি’ ছবিতে। (Remembering Shammi Kapoor)


প্রথম ছবি ব্যর্থ হলেও, ঝকঝকে চেহারা এবং পারিবারিক ঐতিহ্য, দুইয়ের জন্যই সুযোগের অভাব হয়নি শাম্মির। মধুবালা, নূতন, সুরাইয়া, মীনা কুমারীর মতো সফল নায়িকাদের সঙ্গে পর পর ছবি হাতে আসে। কিন্তু ‘রেল কা ডিব্বা’, ‘নকাব’, ‘লায়লা মজনু’ ‘ঠোকর’, ‘চোর বাজার’ পর পর সব ছবিই মুখ থুবড়ে পড়ে বক্স অফিসে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত কোনও ছবিতেই সেভাবে দাগ কাটতে পারেননি শাম্মি। এর পর নাসির হুসেনের পরিচালনায় ‘তুমসা নহি দেখা’ ছবিটি মুক্তি পায়। তার পর মুক্তি পায় ‘দিল দেকে দেখো’। এই দু’টি ছবিই শাম্মিকে ঘরে ঘরে জনপ্রিয় করে তোলে। ঝকঝকে চেহারা, কেতাদুরস্ত সাজগোজ এবং সর্বোপরি প্রেমিকসুলভ দৃষ্টি, মেয়েদের মন জয় করে নেন অচিরেই। 


এর পর ১৯৬১ সালে ‘জঙ্গলি’ ছবিটি মুক্তি পায়। এখান থেকেই ‘শাম্মি ঘরানা’র ছবির সূচনা মায়ানগরীতে, যা বর্তমানে রোম্যান্টিক কমেডি এবং মিউজিক থ্রিলারের গোত্রে পড়ে। শাম্মির ছবিতে মহম্মদ রফির গান একরকম বাঁধাধরা হয়ে যায়। আশা পারেশ, সায়রা বানু, শর্মিলা ঠাকুর, সাধনার মতো নায়িকারা শাম্মির নায়িকা হয়েই মায়ানগরে পরিচিতি পান। ছয়ের দশকে ‘রাজকুমার’, ‘প্রফেসর’, ‘দিল তেরা দিওয়ানা’, ‘চায়না টাউন’, ‘কাশ্মীর কি কলি’, ‘ব্লাফ মাস্টার’, ‘তিসরি মঞ্জিলে’র মতো একের পর এক সফল ছবি উপহার দেন শাম্মি। ১৯৬৮ সালে ‘ব্রহ্মচারী’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারও পান। সাতের দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত মায়ানগরীর একমাত্র নাচে পারদর্শী নায়ক ছিলেন শাম্মি। সেই সময় কোরিওগ্রাফার নিয়োগের চল ছিল না। গান চালিয়ে নিজেই নাচের বিভিন্ন কায়দা তুলে আনতেন, যে কারণে তাঁকে ভারতের এলভিস প্রিসলিও বলা হতো। 


আরও পড়ুন: Dev Exclusive: 'বাঘাযতীন পছন্দ না হলে আর কোনওদিন আমার ছবি দেখবেন না', এবিপি আনন্দে অকপট দেব


‘বদতমিজ’, ‘সচ্চাই’, ‘লাট সাহেব’, ‘তুমসে অচ্ছা কউন হ্যায়’, ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’, ‘প্রিন্স’, একের পর এক সফল ছবি উপহার দিতে থাকেন শাম্মি। কিন্তু সাতের দশকে শারীরিক অসুস্থতা ভোগাত শুরু করে শাম্মিকে। স্থূলতার জন্য প্রেমের ছবি থেকে বাদ পড়তে শুরু করেন। ততদিনে রাজেশ খন্না চলে এসেছেন। ১৯৭৪ সালে নায়ক হিসেবে শেষ বার ‘ছোটে সরকার’ ছবিতে দেখা যায় শাম্মিকে। ১৯৭৪ সালে ‘জমির’ ছবিতে সায়রা বানুর বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন শাম্মি। এককালে সায়রার বিপরীতে নায়ক ছিলেন তাই প্রথমে রাজি হননি। অনেক চেষ্টা-চরিত্রের পর রাজি হন শাম্মি। ১৯৭৭ সালে ‘পরবরিশ’ ছবিতে বিনোদ খন্না এবং অমিতাভ বচ্চনের পালকপিতার চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৪ সালে ‘মনোরঞ্জন’ এবং ১৯৭৬ সালে ‘বুন্দল বাজ’ ছবি দু’টি পরিচালনাও করেন শাম্মি। ছবি দু’টি সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হলেও, বক্স অফিসে সফল হয়নি। শাম্মির ভাবনা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকাতেই সেই সময়ের দর্শক ছবি দু’টি গ্রহণ করতে পারেন বলে মেন করেন সমালোচকরা। 


সময়ের সঙ্গে শুধুমাত্র পার্শ্বচরিত্রেই দেখা যেতে থাকে শাম্মিকে। সেই তালিকায় রয়েছে ‘প্রেমরোগ’, ‘হিরো’, ‘বেতাব’, ‘বিধাতা’র মতো ছবি। ‘বিধাতা’র জন্য সেরা সহ-অভিনেতার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারও পান। ১৯৯২ সালে ‘তহলকা’ ছবিতে খলনায়কের ভূমিকাতেও দেখা যায় তাঁকে। নয়ের দশকে টেলিভিশনেও পদার্পণ করেন শাম্মি। ‘চট্টানে’র মতো সিরিয়ালে অভিনয় করেন। নয়ের দশকের শেষ দিক থেকে কাজ কমিয়ে দেন শাম্মি। শেষ বার ২০১১ সালে কপূর পরিবারেরই উত্তরাধিকারী রণবীর কপূরের সঙ্গে ‘রকস্টার’ ছবিতে দেখা যায় শাম্মিকে। ১০০-র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন শাম্মি। শক্তি সামন্তের মতো পরিচালক বার বার শাম্মিকে নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন। কিন্তু তার পরও শাম্মির প্রতিভার সঠিক ব্যবহার হয়নি বলে আজও মনে করেন তাঁর গুণমুগ্ধরা। অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহও তাঁদের মধ্যে পড়েন। উত্তম কুমারের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল শাম্মির। কলকাতায় এলে উত্তমের ছবি দেখা থেকে আড্ডা, কিছু বাদ দিতেন না। হিন্দি ছবিতে উত্তমের ছবি যখন মুখ থুবড়ে পড়ে, সেই সময় শাম্মিই তাঁকে বোঝান যে, উত্তমের মতো প্রতিভার কদর করতে জানে না বলিউড। 


ব্যক্তিগত জীবনের ঝড়ঝাপ্টাও শাম্মির অভিন।জীবনের উপর প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন অনেকে।  পাঁচের দশকে দাদা রাজ কপূর এবং ভাই শশী কপূরের সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন শাম্মি। সেখানের এক হোটেলে সেকালের বিখ্যাত ক্যাবারে ডান্সার, মিশরের নাদিয়া গামালের প্রেমে পড়ে যান শাম্মি। তখন শাম্মির বয়স ২২, নাদিয়ার ১৭। শাম্মিকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে বলেছিলেন নাদিয়া। তার পরও যদি প্রেম টিকে তাকে, তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববেন বলে জানান। নাদিয়ার আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়। দূরত্ব তাঁদের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যস্ততার মধ্যে আলাদা করে দেখা-সাক্ষাৎই হতো না তাঁদের। একটা সময় সম্পর্ক ভেঙে যায় যদিও, কিন্তু পরবর্তী কালেও নাদিয়ার কথা বার বার উঠে এসেছে শাম্মির মুখে। অভিনেত্রী মুমতাজের সঙ্গেও সম্পর্ক হয় শাম্মির। কিন্তু কপূর পরিবারের শর্তানুযায়ী অভিনয় ছেড়ে, শুধু ঘরকন্নায় রাজি হননি মুমতাজ। এর পর অভিনেত্রী গীতা বালির প্রেমে পড়েন শাম্মি। আলাপের চার মাসের মধ্যেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা। তাঁদের দুই সন্তান, ছেলে আদিত্য রাজ কপূর এবং মেয়ে কাঞ্চন কপূর। কিন্তু মাত্র ৩৫ বছর বয়সে স্মলপক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যান গীতা। চার বছর পর গুজরাতের বাসিন্দা নীলা দেবীকে বিয়ে করেন শাম্মি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একসঙ্গে ছিলেন তাঁরা। শাম্মি এবং নীলা আলাদা করে সন্তান নেননি আর। আজও শাম্মির প্রথম পক্ষের সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গেই রয়েছেন নীলা। 


একটি সাক্ষাৎকারে নীলা জানান, ছোট থেকে নায়ক শাম্মির অনুরাগিণী ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হবে কখনও ভাবেননি। কিন্তু শাম্মি নিজের ভাল-মন্দ কিছুই লুকোননি তাঁর কাছ থেকে। একটু বদরাগী স্বভাবের ছিলেন শাম্মি, একটুতেই মেজাজ হারাতেন। কিন্তু পরে অনুশোচনা হতো, নিজেকে সংশোধন করতেন বলে জানান নীলা। মদ্যপান এবং ধূমপানের প্রতি আসক্তি ছিল শাম্মির। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরও নিয়মিত মদ্যপান করতেন শাম্মি। কিন্তু যতদিন বেঁচে ছিলেন, নিয়ম করে প্রতি বছর ১ থেকে ২১ জানুয়ারি সুরা ছুঁয়ে দেখতেন না। কারণ ১ থেকে ২১ জানুয়ারির মধ্যেই স্মলপক্স কেড়ে নেয় প্রথম স্ত্রী গীতাকে। একসময় দিনে ১০০টি করে সিগারেট খেতেন শাম্মি। কিন্তু কম্পিউটারের প্রতি আসক্তি তাঁকে চেয়ার থেকে উঠতে দিত না একটা সময়। তার জেরে ধূমপানের বদভ্যাস কাটিয়ে ওঠেন। কম্পিউটার এতই পছন্দ ছিল শাম্মির যে ইন্টারনেট ইউজার্স কমিউনিটি অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যানও ছিলেন নিজে। এথিক্যাল হ্যাকার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতো সংগঠনের প্রতিষ্ঠার নেপথ্যেও ছিলেন শাম্মি। কপূর পরিবারের ইতিহাস নিয়ে পৃথক একটি ওয়েবসাইটও চালু করেন। 


শারীরিক অসুস্থতার জেরে একসময় চেয়ার থেকে উঠতে পারতেন না শাম্মি। সেই সময় দীর্ঘ সাত-আট বছর তিনি গান শেখেন। শাহিদ কপূর এবং করিনা কপূরের ‘জব উই মেট’ ছবির ‘আওগে জব তুম ও সজনা’ গানটি এতই প্রিয় ছিল যে, প্রায়শই গুনগুন করতেন। কাশ্মীরের প্রতি বিশেষ টান ছিল শাম্মির। কাশ্মীর থেকে অসম্ভব ভালবাসাও পেয়েছেন তিনি। প্রতিবার কাশ্মীর গিয়ে যে হোটেলে থাকতেন শাম্মি, সেখানকার শতবর্ষ উদযাপনে শাম্মিকে আমন্ত্রণ কার হয়েছিল। কাশ্মীরে যাতে অসুবিধা না হয় তাঁর, তার জন্য ডায়ালিসিস থেকে প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসার ব্যবস্থাও কার হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে আর যোগ দেওয়া হয়নি শাম্মির। ২০১১ সালের ১৪ অগাস্ট মারা যান শাম্মি। বাবার অবর্তমানে শাম্মির ছেলেমেয়েরা ওই হোটেল যান এবং সেখানে তাঁর স্মৃতিতে একটি গাছ বসিয়ে আসেন। শাম্মির নামে ওই হোটেলে একটি বাগানও রয়েছে।