কলকাতা: ঠিক যেন ঈশ্বরকে ছুঁয়ে আসা, তীর্থক্ষেত্রের পূণ্য অর্জন করে ফেরা। অনেক কথা মনে এসেও যেন সবটুকু গুছিয়ে লিখে ফেলা যায় না সঙ্গে সঙ্গে। আবেগের ঘোর কাটতে সময় লেগে যায় বেশ কিছুটা! সেই ছোটবেলায় কালো রিসিভারের ওপার থেকে কথা বলেছিলেন গমগমে গলার মানুষটার সঙ্গে। আবদার করেছিলেন, 'হীরক রাজার দেশের রেকর্ড তো রোজ শুনি, আমার গুপি গায়েন বাঘা বাইনের রেকর্ডটা চাই। কোথাও পাচ্ছি না।' আজ প্রথমবার সেই ঘরে দাঁড়িয়ে ছোটবেলার সেই স্মৃতিটা যেন ফের জ্যান্ত হয়ে উঠল তাঁর কাছে। সেই চেয়ার.. সেই পিয়ানো.. এই টেলিফোনটা কানে ধরেই সেদিন কথা বলেছিলেন সত্যজিৎ রায় (Satyajit Roy)! আর ওপারে ছিলেন রূপম ইসলাম (Rupam Islam)।


সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা একগুচ্ছ ছবির সঙ্গে বেশি কথা লিখতে পারেননি রূপম। প্রথমবার চাঁপা ফুলরঙা বাড়িটায় পা রাখার আবেগে ভাসছেন তিনি। সঙ্গীতশিল্পীর অভিজ্ঞতার কথা জানতে তাঁকে ফোন করেছিল এবিপি লাইভ। মোবাইলের ওপারে রূপমের গলায় সারাদিনের ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। প্রশ্ন করতে হল না বেশি। গল্পের মত রূপম বলতে শুরু করলেন, 'আজ আমি যে চেয়ারটাকে প্রণাম করেছি, যিনি সেখানে বসতেন, তিনি আমার ঈশ্বর। ১৯৮০ সাল, আমার তখন ৬ বছর বয়স। 'হীরক রাজার দেশে' মুক্তি পেল সেই বছর। ছবিটা দেখে বাবার কাছে বায়না ধরলাম, এই রেকর্ডটা কিনে দিতে হবে। গড়িয়াহাটের আনন্দমেলা থেকে বাবা কিনে দিলেন। তারপর বাড়িতে নিয়মিত সেই রেকর্ড চলত। শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সেই প্রথম সত্যজিৎ রায়কে ভালোবাসা।'


তারপর বয়স বেড়েছে রূপমের, সঙ্গে বেড়েছে সেই কিংবদন্তির প্রতি ভালোবাসা, মুগ্ধতা। যেন ঘোর লাগা গলায় রূপম বলে চলেছেন, 'সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ঠিক মোক্ষম সময়ে মোক্ষম আবহসঙ্গীতটা আসত। ঘরে ছবি চললে যেন না দেখেই বলে দেওয়া যেত ওটা কার ছবি। সেই থেকেই ভালবাসতে শুরু করি মানুষটাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সত্যজিৎ রায় আমার ঘরের দেওয়ালে চিরস্থায়ী ছবি হিসেবে রইলেন। বাবা দেখতেন আর হাসতেন। মজাও করতেন মাঝে-মধ্যে। একদিন আমায় বললেন, 'তুই ওঁর এত ভক্ত, একদিন ফোনে কথা বলিয়ে দেব তোর সঙ্গে।' আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে ওঁর আলাপ ছিল। মা একসময় নাটকের মঞ্চে অভিনয় করতেন। 'অপরাজিত'-র সময় আমার মা-কে একটা চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। মা পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার জন্য করে উঠতে পারেননি। তারপর একদিন বাবা ফোন ধরিয়ে দিলেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কথা বললাম। যেন স্বপ্ন! কী কথোপকথন হয়েছিল সেটা আমি আমার প্রথম বই 'রূপম অন দ্য রকস'-এ লিখেছিলাম।


এরপর সময় পেরিয়ে গিয়েছে বেশ অনেকটা। খ্যাতি বেড়েছে, ভারি হয়েছে প্রাপ্তি আর ভালবাসার ঝুলিও। তবু রূপম কখনও ভাবতে পারেননি তিনি সন্দীপ রায়কে (Sandip Roy) গিয়ে বলবেন, 'এই বাড়িটা আমার কাছে তীর্থক্ষেত্র!' সময়ের সময় হলে বোধহয় সুযোগ আসে এমনিতেই। এক চিকিৎসক দাদার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে পা রাখলেন রূপম। ঘুরে দেখলেন সেই বই ঠাসা ঘরটা, ছুঁয়ে দেখলেন কিংবদন্তির স্টাডিরুম, চেয়ার, পিয়ানো। রূপম বললেন, 'কী ভীষণ মাটির কাছের মানুষ সন্দীপ রায় আর ললিতা রায়। কখনও নিজেদের ওজনটা বুঝতেই দেন না। আমরা যা যা নিয়ে কথা বলছি, ললিতা রায় সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘর থেকে সেই সমস্ত নথি নিয়ে আসছেন। জমাটি আড্ডায় কেটে গেল সন্ধেটা। শেষে আমায় বললেন, 'আজ তো কিছু খেলেই না। আরও একদিন এসে ভাল করে খাওয়া দাওয়া করতে হবে কিন্তু!' আমার মত একটা সাধারণ মানুষকে এতটা গুরুত্ব, এতটা আন্তরিক আতিথেয়তা.. এই জন্যই ওঁরা বড় মানুষ।'


রূপম ভাসছেন, ডুবছেন ভাললাগায়। স্বপ্নালু স্বরে খানিকটা যেন স্বগতোক্তি করলেন রূপম, 'আমি ওই চেয়ারটা ছুঁয়েছি.. পিয়ানোটার পাশে দাঁড়িয়েছি... টেলিফোনটা দেখে মনে হয়েছে ঠিক এইখানে বসেই তো উনি আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন... ওই স্টাডি রুমটা একটা যাদুঘর। আপনি গিয়েছেন কখনও....?'