পুরুষোত্তম পন্ডিত, কলকাতা: তিরঙ্গা লেহরাকে আউঙ্গা, ইয়া ফির তিরঙ্গেমে লিপটকে কে আউঙ্গা। পর আউঙ্গা জরুর।’ হ্যাঁ। এভাবেও ফিরে আসা যায়। নিজের স্বপ্ন পূরণ করে ফিরেছিলেন ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা। কার্গিল যুদ্ধে ভারতীয় ভূখন্ডে ত্রিবর্ণ পতাকা উড়িয়ে ফিরেছিলেন, কিন্তু নিজেকে পতাকায় মুড়ে। দেশের প্রতি কর্তব্যের, সাহসিকতার, শৌর্যের, বীরত্বের এক চিরন্তন স্মারক হয়ে ফিরেছিলেন ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা।
মরোণোত্তর পরম বীর চক্র পদকে সম্মানিত এই তরুণ ভারতীয় সেনার বায়েপিক ‘শেরশাহ’ মুক্তি পেল আমাজন প্রাইম ভিডিওতে। ‘শেরশাহ’ ছিল বিক্রম বাত্রার কোড নেম। ১৯৯৯-এ যখন কার্গিলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে গিয়েছে, তখন ভারতীয় ভূখন্ড পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব নিয়ে রুক্ষ, শীতল, মৃত্যু-সঙ্কুল পার্বত্য পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন অকুতোভয় বিক্রম। একের পর এক লক্ষ্য জয় করে বেস-এ তিনি বার্তা পাঠাতেন, ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’। প্রাণোচ্ছ্বল সেই তরুণের জীবন কাহিনিকেই কিছুটা সিনেমার রঙে রাঙিয়ে দর্শকদের সামনে হাজির করেছেন পরিচালক বিষ্ণু বর্ধন। বিক্রম বাত্রার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সিদ্ধার্থ মালহোত্র। আর বাস্তবে বিক্রম বাত্রার প্রেমিকা ডিম্পল চিমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কিয়ারা আডবাণী।
বলাই বাহুল্য, ‘শেরশাহ’-কে শুধুমাত্র দেশাত্মবোধে পরিপূর্ণ এক সংলাপময় ছবি হিসেবে উপস্থাপিত করতে চাননি পরিচালক। কিশোরাবস্থা থেকেই কীভাবে মনে দেশাত্মবোধ জন্মায়, সেনাবাহিনীর প্রতি ভালবাসা জন্মায় সেই প্রেক্ষাপট ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে এই ছবির কাহিনিতে। এর পাশাপাশি প্রেমও এসেছে। বিক্রম বাত্রার সঙ্গে ডিম্পল চিমার প্রেমপর্বের কাহিনি এই ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এর পাশাপাশি সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে বিক্রম বাত্রার মানসিক দ্বন্দ্বের দিকটিও তুলে ধরা হয়েছে। মার্চেন্ট নেভির বদলে ভারতীয় সেনা বাহিনীতে যোগ। পরিবার, ভালবাসাকে ছেড়ে রেখে দেশের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন বিক্রম। তারপর কার্গিল অধ্যায়। শেষ এবং শেষ থেকেই নতুন করে শুরু বিক্রমের বীরগাথা। সিনেমায় ক্যাপ্টেন বিক্রমের চরিত্রে এর আগে অভিনয় করেছেন অভিষেক বচ্চন। এলওসি কার্গিল ছবিটির একটি দৃশ্যে ভারতীয় এবং পাক সেনা যখন মুখোমুখি লড়ছে, তখন মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়ে করা পাক সেনার মন্তব্য কানে আসতেই বন্দুকের নলে তার জবাব দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা। বুলেট বর্ষণ করতে করতেই অভিষেকের মুখে ছিল সেই সংলাপ, ‘ফ্রম মাধুরী, উইথ লাভ’। সেই সংলাপই এই ছবিতে ফিরে এসেছে হিন্দিতে। কোন বুলেটে কার মৃত্যু লেখা থাকবে, তা আগাম আন্দাজ করা যায় না। সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণে নিজের দলের সঙ্গীকে হারানোর পর সিদ্ধার্থর মুখে শোনা যায়, ‘এর পর থেকে আমার দলের আর কাউকে আমি মরতে দেব না। মৃত্যু আমার হতে পারে, আমার সঙ্গীদের হবে না।’ এই সংলাপ মন ছুঁয়ে যায়।
এবার ছবিটির মূল অংশে আসা যাক। বলতেই হয়, যুদ্ধের দৃশ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারবেন না দর্শকেরা। প্রথমত ছবিটির আদ্যোপান্ত আগে থেকেই অনেকটা জানা। ক্লাইম্যাক্সই হোক বা ছবির অন্য যে কোনও অংশ, পরিচালক ভেবেছেন দর্শকদের ‘নতুনত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনও দাবি দাওয়া’। ভুলটা এখানেই। কিছুটা সিনেম্যাটিক রঙ চড়িয়ে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার বায়োপিক হতেই পারে, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যঘটনাকে একটুও অতিরঞ্জিত না করেও নতুনত্বের স্বাদ দেওয়াটাই পরিচালকের মুনশিয়ানা। যা এই ছবিতে অনুপস্থিত। ডিটেলিং রয়েছে। কিন্তু সেই ডিটেলিং মনে আলাদা করে দাগ কাটতে পারেনি। কার্গিলের মত হাই-অল্টিচিউডে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দৃশ্যায়নে আরও নতুনত্বের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল না ‘শেরশাহ’। পরিচালক সুজিত সরকারের ‘ম্যাড্রাস ক্যাফে’-তে প্রায় যুদ্ধ তুল্য যে সিকোয়েন্সগুলি দর্শকেরা দেখেছেন, তাতে বন্দুকের গুলির উষ্ণতা, বারুদের গন্ধ যেন অনুভব করা গিয়েছিল। এতটাই সজীব ছিল সেই ছবির অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলি। ‘শেরশাহ’ তেমন কোনও অভিজ্ঞতা দিতে পারল না। ‘যাহাই অনুমান করা হয়, তাহাই ঘটিয়া চলে’-এই ফর্মুলা ধরেই এগোতে থাকে ছবিটি। মন যা বলছে, সিনেমাতেও পর পর ঠিক তেমনটাই ঘটে চলেছে, এই যদি হতে থাকে তাহলে আর উত্তেজনা থাকবে কেন? ছবির শুরু থেকেই ক্লাইম্যাক্সের প্রতীক্ষায় কাউন্টডাউন চলতে থাকে। ছবিটিতে ঘিরে আবেগ রয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্লাইম্যাক্সেও পরিচালক সেই আবেগের মোড়কেই যবনিকা টানলেন চিরপরিচিত বলিউডি কায়দায়।
অভিনয়ের দিক থেকে সিদ্ধার্থ মালহোত্র এবং কিয়েরা আডবাণীর প্রশংসা করতেই হয়। ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার চরিত্রের মধ্যেই ফিল্মি ছোঁওয়া ছিল। সেই দিকটিও সযত্নে তুলে ধরেছেন সিদ্ধার্থ। বিক্রম-ডিম্পলের অসম্পূর্ণ প্রেম কাহিনি কোথাও যেন একটা আলাদা সম্পূর্ণতা পায় শাশ্বত ভালবাসায়। বাস ছাড়ার সময় সিদ্ধার্থর আলিঙ্গনে কিয়ারার মুখে সেই সংলাপ কানে বাজতে থাকে ‘সাচ্চি মে ফাঁস গই।’ ভালবাসা অমরত্ব পায় সেই সংলাপেই। শতাফ ফিগার, শিব পন্ডিতের অভিনয়ও চোখে পড়বে। তবে ‘শেরশাহ’-র পুরো কাহিনি জুড়েই দর্শকের চোখ আটকে থাকবে সিদ্ধার্থ-কিয়ারার উপরেই। মাত্র ২৪ বছর বয়সী এক যুবক নিজের জীবন দিয়েও কীভাবে ফিনিক্সের মত বেঁচে থাকে, সেই কাহিনির আয়নায় ‘শেরশাহ’-র চোখের কোল ভারী করতেই পারে। ছবিটির শেষে সময় থমকে দাঁড়ায় ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার সাক্ষাৎকারের ক্লিপিংসে।