কলকাতা: ছবির চিত্রনাট্যে প্রস্থেটিক মেকআপের প্রয়োজন ছিল সেই খবর আগেই শুনেছিলেন তিনি। রূপটানের জন্য ডাক পরল তাঁরই। উচ্ছ্বসিত হয়ে সেটে গেলেন ঠিকই কিন্তু তার পরের ঘটনা সুখকর নয়। বলা হল, 'ছবির বাকি সমস্ত মেকআপ তোমার দায়িত্ব, কিন্তু হাত দিতে পারবে না প্রস্থেটিক মেকআপে'। বই পড়ে, ইন্টারনেট ঘেঁটে ততদিনে প্রস্থেটিক মেকআপকে বেশ কিছুটা আয়ত্তে এনে ফেলেছিলেন তিনি। বললেন, 'আসল শিল্পটাই যদি না করতে পারলাম, তাহলে আর কিসের রূপটান.. কিসের শিল্প!' ফ্লোর থেকে সেদিন ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে ফিরে এসেছিলেন সোমনাথ কুণ্ডু (Somnath Kundu)। আর এখন? টলিউডে প্রস্থেটিক মেকআপের সঙ্গে কার্যত সমার্থক হয়ে গিয়েছে এই নামটাই।
শিল্পীর আসল চেহারার কোনওরকম বদল না ঘটিয়ে কেবলমাত্র রূপটানে তাঁকে সম্পূর্ণ অন্য মানুষের আদল দেওয়াই প্রস্থেটিক মেকআপের লক্ষ্য। ঠিক কিভাবে হয় এই প্রস্থেটিকের কাজ? এবিপি লাইভকে ফোনের ওপার থেকে সোমনাম কুণ্ডু বলছেন, 'গোটা ব্যাপারটাই বিজ্ঞান। আমরা যাঁর মেকআপ করব তাঁকে সবসময় সামনে পাই না। তাই প্রথমেই তাঁর একটা মুখের আদল বা ছাঁচ বানিয়ে নিতে হয়। ভিতরের দিকটা শিল্পীর আসল মুখের আদল থাকে। আর বাইরের দিকটা যেমন নাক, চোখ, মুখ করতে চাই সেটা বানিয়ে নিই আমরা। এরপর তার ওপরেই মেকআপ করা হয়। প্রত্যেকদিনের জন্য আলাদা আলাদা সেট তৈরি করতে হয়। তবে টলিউডে সবসময়েই কম বাজেটে কাজ করতে হয়। হলিউড প্রস্থেটিকের জন্য যে যে জিনিস ব্যবহার করে আমরা সেটা করার সুযোগ পাই না। আরও একটা সমস্যা হল সময়। বলিউডে প্রস্থেটিক মেকআপ নিয়ে সাধারণত ২-৩ ঘণ্টা শ্যুটিং করতে হয় শিল্পীদের। এখানে সেই সময়টাই অন্তত ৬-৮ ঘণ্টা। 'গুমনামী'-র কাজ করার সময় বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্য়ায়) প্রস্থেটিক নিয়ে টানা ১৮ ঘণ্টা শ্যুটিং করেছিলেন। এতে শিল্পীর কষ্ট হয় তো বটেই। সেইসঙ্গে আমায় সবসময় মাথায় রাখতে হয় মেকআপ যেন শ্যুটিংয়ের মাঝপথে নষ্ট না হয়। তবে হ্যাঁ, বিষয়টা কঠিন শোনালেও আমার কাছে বেশ মজার।'
গানের কথা মনে না থেকেও ছাড়াল ১ মিলিয়ানের লক্ষ্যমাত্রা , 'মায়াবী চাঁদের রাতে' ভাসছে নেটদুনিয়া
'গুমনামী'-র প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে শুরু করে 'স্বস্তিক সংকেত'-এর শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়, 'মহানন্দা'-র গার্গী রায়চৌধুরী কিম্বা জিতু কমলকে সত্য়জিৎ করে তোলা, পরিচালক , অভিনেতা, অভিনেত্রীরা সোমনাথের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একসময় যে শিল্পীকে প্রস্থেটিকের কাজে হাত দিতে বারণ করা হয়েছিল, এখন প্রস্থেটিকের জগতে তাঁকে চোখে হারায় টলিউড। এই পরিবর্তনে কী মনে হয়? একটু লাজুক গলায় সোমনাথ বললেন, 'প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে! আমারও লাগে। তবে একটা ভয় কাজ করে। প্রশংসা পাওয়া মানেই দায়িত্ব বাড়া। কোনওদিন যদি কোনও কাজে ভুল হয়ে যায়, বদনামটাও প্রবল হবে। আর মনে হয়, এত কম বাজেটে আশানুরুপ মেকআপ করে যেতে পারব তো! ছবির প্রযোজকরা সবসময় বলেন, ছবির বাজেট কম। টলিউডে এতরকম প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েও নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি সবসময়।'
মা, স্ত্রী আর এক পুত্রসন্তান নিয়ে সোমনাথের পরিবার। ছেলে দশম শ্রেণীর ছাত্র। টলিউডের প্রস্থেটিকের জগতে বাবার উত্তরসূরি কি সেই? একটু ভেবে শিল্পী বললেন, 'জানি না! আমরা তিন পুরুষ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত। বাবা আর দাদু কস্টিউম ডিজাইন করতেন। আমি এলাম মেকআপে। ছোটবেলা থেকে ছেলেকে দেখতাম ওর মেকআপে দারুণ আগ্রহ। সবকিছু ঘেঁটে দেখত। এমনকি প্রস্থেটিকের মূল বিষয়টাও ও জানে। তবে ছেলে এখন বলে ও মেডিক্যাল পড়বে। চিকিৎসক হবে। আসলে ও দেখেছে কাজ জেনেও বাবা মাসের পর মাস বাড়িতে বসে আছে। ওর মাকে প্রশ্ন করত, 'বাবা বাড়িতে বসে আছে কেন? কাজ নেই?' দশম শ্রেণীতে উঠে এখন বলে, 'এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কী লাভ যেখানে কাজ জেনেও বসে থাকতে হয়!' ওকে কখনও জোর করব না, সমর্থন করব কেবল।'
তাহলে সোমনাথ কুণ্ডুর পরে কি ফের মুম্বই থেকে রূপটানের শিল্পী আনাতে হবে টলিউডকে? সোমনাথ বললেন, 'কেন অনেক ছোট ছেলেমেয়েরা ভালো কাজ করছে। সত্যি কথা বলতে, আমার নিজের কোনও পুঁথিগত শিক্ষা নেই। বই পড়ে আর ইউটিউবে দেখে শেখা। এখনও অনেকে আমায় ফোন করেন। তাঁদের কোন বই পড়তে হবে বা কিভাবে ছাঁচ তৈরি করতে হবে বলে দিই। বহুদিনের ইচ্ছা একটা শিক্ষাকেন্দ্র খুলব। তবে সেটাকে আমি পেশা বা ব্যবসা হিসেবে নিতে চাই না কখনও। সময় পেলে ছেলেমেয়েদের প্রস্থেটিক মেকআপ শেখাব, সৃজনশীল কিছু তৈরি করব। অ্যাসোসিয়েশনে কথা বলেছি। অনেক খরচের ব্যাপার। যাঁরা কাজ করছেন ঠিকভাবে শেখাতে পারলে সেই ছেলেমেয়েরাই হবে সোমনাথ কুণ্ডুর উত্তরসূরী।'