কলকাতা: ওয়েব সিরিজে 'জমজমাট' ফেলুদা। দার্জিলিংয়ের বুকে, সেপিয়া টোনের চিত্রনাট্যে রহস্য সমাধান করছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় (Srijit Mukherjee)-র ফেলুদা টোটা রায়চৌধুরী (Tota Roychowdhury)। কিন্তু ১০ দিনের মাথায় দর্শকদের মধ্যে ঠিক কী প্রতিক্রিয়া হল 'ফেলুদা'-কে নিয়ে? প্রশংসা বা সমালোচনা, টোটার কপালে দুইই জুটল। কিন্তু তারও আড়ালে কী লুকিয়ে রইল অন্য কিছু? সামাজিক মাধ্যমে প্রথমবার ফেলুদাকে নিয়ে কলম ধরলেন টোটা। 


সোশ্যাল মিডিয়ায় টোটা যা লিখলেন, তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না ঘটিয়ে সরাসরি রাখা হল। টোটা লিখছেন, 'দার্জিলিং জমজমাট স্ট্রিমিং এর দশ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এই দশ দিনে social mediaতে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। কখনও ভালোবাসার জোয়ারে ভেসেছি তো কখনো ঘৃণার বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়েছি। এর মধ্যে আমরা একটা রেকর্ডও সৃষ্টি করেছি। বাংলা OTT প্ল্যাটফর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শক এই seriesটি দেখেছেন। এর পেছনে সব দর্শকেরই অবদান আছে। তাই আপনাদের জঘন্য লেগে থাকুক বা ভালো, আমি আমাদের টীমের তরফ থেকে আপনাদের প্রত্যেককেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।



সাধারণত, সমালোচনাকে আমি স্বাগত জানাই। objective & constructive criticism থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। এবারও যেমন শিখেছি। তবে এবারে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। বেশ কিছু সমালোচনা গঠনমূলক তো নয়ই, অসম্ভব ঘৃণা মিশ্রিত, যার প্রধান উদ্দেশ্যই হল পরিচালককে বা অভিনেতাদের হেয় করা। বেশ কিছু মানুষ জোরের সঙ্গে দাবি করছেন যে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের গত কয়েকটা কাজ নাকি পাতে দেওয়ার অযোগ্য। অথচ তাঁরা সেই অযোগ্য কাজগুলোই যে কেন পরপর দেখছেন সেই রহস্যের সমাধান করতে হয়তো ফেলুদাকেই ডাকতে হবে! ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি যে সৃজিতের মত পরিশ্রমী, কাজের প্রতি সমর্পিত ও কাজপাগল পরিচালক আমি আমার পুরো কেরিয়ারে (প্রায় পঁচিশ বছরে) দুটি দেখিনি। আমি কিন্তু বেশ কিছু বড়মাপের পরিচালকদের সাথে কাজ করেছি এবং ভেবেচিন্তেই কথাটা লিখলাম। দুম করে আবার বলে বসবেন না যে পরের ছবিতে চান্স দিচ্ছে নাকি! ও কিন্তু ছবিতে আমাকে কোনোদিন নেয়নি এবং বাংলা হিন্দি মিলিয়ে আগামীতে যে ছবিগুলো করছে সেগুলোতেও আমার স্থান নেই। আর ইদানীং মুম্বাইয়ে কিঞ্চিৎ কাজ করছি বলে এটা জোরের সাথে বলতে পারি যে বাংলা থেকে সৃজিতই একমাত্র পরিচালক যাকে ওঁরা চেনেন এবং যার কাজের সম্বন্ধে ওনাদের সম্যক ধারণা আছে। তা সে করণ জোহর হোক, রণবীর সিং বা আলিয়া ভাট হোক বা শাবানা আজমি। রকি রানী কি প্রেম কাহানি তে এই অধম একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করছে এবং set-এ যেদিন সৃজিত এসেছিল সেদিন সেটা প্রত্যক্ষ করেছি বলেই লিখছি। গেঁয়ো যোগী যে ভীখ পায়না সেটা আমার থেকে ভালো আর কে জানবে।

 



এবার আসি আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার এর ক্ষেত্রে। জঘন্যতম ফেলুদা, আড়ষ্ট, কেতাবাজ, চিবিয়ে কথা বলে আরও নানান বিশেষণে আমায় ভূষিত করা হয়েছে। আমি নিজে যতবারই অনুরোধ বা বিনতি করি না কেন যে সৌমিত্রবাবু বা সব্যসাচীবাবু হিমালয় সম, ওনাদের সাথে আমার তুলনা করা আর সৌরভ বা ধোনির সঙ্গে ক্যাম্বিস বলের পাড়ার ক্রিকেটারের তুলনা করা, একই পর্যায়ের, তাই দয়া করে তুলনা টানবেন না। কিন্তু তারপরেও কিছু objectivity বিসর্জন দেওয়া মানুষ তুলনা টানবেনই কারণ মানুষকে ছোট করে যে অনাবিল আনন্দ আরোহন করা যায় এবং নিজের ক্ষুদ্রতা থেকে যে ক্ষণিকের মুক্তি পাওয়া যায় তা থেকে কিছু মানুষ কেন নিজেদের বঞ্চিত করবেন! তাই বারবার তুলনা টানা এবং ট্রোল করে পৈশাচিক আনন্দে লিপ্ত হওয়া। তা বেশ। এটাও তো একপ্রকার বিনোদন।

 


 



আমার চোখে ফেলুদা এক অনমনীয় চরিত্রের দৃঢ়চেতা মানুষ। সে যতই রাত জাগুক না কেন ভোরে বা সকালে ঠিক যোগব্যায়াম করবেই। মার্শাল আর্ট এও সে পারদর্শী। এই ধরনের মানুষদের posture সম্বন্ধে কি ধারণা আছে? যদি না থাকে তাহলে খেয়াল করবেন যে তারা straight & square shouldered হন। রায় সাহেবের আঁকা ফেলুদার স্কেচগুলো আরেকবার দেখার জন্য অনুরোধ করছি। সটান শিরদাঁড়া, উচ্চ শির। আমি সেগুলোই অনুসরণ করেছি। এঁদের হাঁটাচলা, movement খুব controlled হয়। তাঁদের মানসিক দৃঢ়তা তাঁদের শারীরিক দার্ঢ্যে প্রকাশ পায়। যাঁরা বলছেন আমাকে আড়ষ্ট লেগেছে তাঁরা কি একটু ভেবে দেখেছেন যে ওই একই সময় তো আমি শ্রীময়ী সিরিয়ালে রোহিত সেন এর রোলে অভিনয় করেছিলাম, প্রায় দেড় বছর ধরে। রোজই তো টিভির পর্দায় দেখা যেত। তখন তো কেউ বলেননি যে আমি ওই দোষে দুষ্ট। তাহলে নিশ্চই কিছু একটা ভেবেই এই characterization টা করেছি, তাই না? কিন্তু তলিয়ে ভাবার সময় কোথায়! মোবাইল চিৎকার করে ডাকছে, ওরে পৃথিবীতে কত কিছু ঘটছে, FOMO FOMO!!!

 



তবে আনন্দের বিষয় হলো যে, সমবেত ফিডব্যাক অনুযায়ী ৮০% মানুষ আমাদের এই সম্মিলিত প্রয়াসকে স্বাগত জানিয়েছেন। সেটা তাঁরা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন এবং তাঁদের মুগ্ধতা ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা নোটবই-কলম নিয়ে দেখতে বসা বিদগ্ধ চলচ্চিত্র বোদ্ধা নন যে অন্যের ঘামঝরানো পরিশ্রমকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজেকে ইন্টেলেকচুয়াল মহাপ্রাণী হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চান। তাঁরা মূলত বিনোদনের জন্যই চলমান-চিত্র প্রত্যক্ষ করে থাকেন, তা সে বড়পর্দা, ছোটপর্দা বা অণু-পর্দাই হোক না কেন। তাঁদের আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও বুকভরা ভালোবাসা জানাই। আগামীতে, অন্তত ব্যক্তিগতভাবে, আমি শুধু তাঁদের কথা মাথায় রেখেই কাজ করব।



একটি উপমা দিয়ে শেষ করছি। আমি অনেকটা পাড়ার সেই ছোট্ট মিষ্টির দোকানের মত। এক চিলতে ঘর, টিমটিম করে আলো জ্বলছে, শো কেসে মোটে ৮-১০ টা আইটেম রাখা। বড় রাস্তার মোড়ে ঝকঝকে, বড়, ব্র্যান্ডেড দোকান আছে। বিপুল মিষ্টির সম্ভার। তবুও পাড়ার মুষ্টিমেয় কিছু বাসিন্দা আমার এই ক্ষুদ্র দোকানে আসেন, জলখাবার সারতে। কোন ফ্লায়িং কাস্টমার খেয়ে যদি বলেন যে; ওহে ময়রা, মিষ্টিটা ঠিক জমল না। তুমি এটা এভাবে, সেটা সেভাবে বানাও। তাহলে আমি বিনীতভাবে ওনাকে জবাব দেব যে আপনি ওই বড় দোকানে যান। বেশ দামী তবে আপনার মনের মত মিষ্টি পাবেন। কিন্তু আমার দোকানে, সন্দেশে কতটা চিনি দেব বা সিঙ্গাড়াতে কতটা আলু পুরবো সেটা আমি ঠিক করবো। খদ্দের নয়। পোষালে খাবেন না পোষালে.......
'

 

এ তো অভিনেতার বয়ান, কিন্তু বিচার দর্শকদের। নতুন ফেলুদাকে কতটা আপন করে নিলেন দর্শক, তা বলবে সময়।