কলকাতা: দেখতে দেখতে আরও একটা বছর শেষের (Year End) মুখে। প্রকৃতির নিয়মে পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে (New Year) আলিঙ্গন করার পালা। আর বছর শেষে ফিরে দেখা কিছু বিশেষ মানুষকে, বলা ভাল তাঁদের স্মরণ করা। প্রত্যেক বছরেই বহু মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে যান কালের নিয়মে। ২০২২ সালেও সেই চিত্রের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। জানুয়ারির গোড়া থেকেই একের পর এক তারকা আমাদের ছেড়ে গেছেন। রোগ-জ্বরা-ব্যধি-দুর্ঘটনা, নানা জনের নানা কারণ। বছর শেষের এই সময়ে দাঁড়িয়ে বিনোদন ও সাহিত্য দুনিয়ার সেই সমস্ত নক্ষত্রদের আরও একবার স্মরণ করা যাক। ফিরে দেখা যাক তাঁদের, ছেড়ে গেলেন যাঁরা...
শাঁওলি মিত্র (Saonli Mitra)
মৃত্যু: ১৬ জানুয়ারি, ২০২২
চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্র। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের কন্যা। বয়স হয়েছিল ৭৪। শাঁওলি মিত্র অভিনয় করেছেন, ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবিতে। এছাড়াও তাঁর অভিনয় প্রতিভবার স্বাক্ষর রেখেছেন অসংখ্য নাটকে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বিতত বীতংশ, নাথবতী অনাথবত্, পুতুলখেলা, একটি রাজনৈতিক হত্যা, হযবরল, পাখি, গ্যালিলিওর জীবন, ডাকঘর, যদি আর এক বার। ২০০৩ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান শাঁওলি মিত্র, ২০০৯ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন তিনি। ২০১২ সালে অভিনয়ে জীবনব্যাপী অবদানের জন্য পান ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মান।
নারায়ণ দেবনাথ (Narayan Debnath)
মৃত্যু: ১৮ জানুয়ারি, ২০২২
দীর্ঘ ২৫ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি থেকে, ডাক্তারদের অক্লান্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথ। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। নার্সিংহোমে শয্যাশায়ী অবস্থাতেই মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘পদ্মশ্রী’ (Padma Shri Medal) সম্মান। রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায় (Arup Roy) এবং স্বরাষ্ট্রসচিব বিপি গোপালিকা হাসপাতালে দেখতে যান তাঁকে। সেখানেই পরিবার-পরিজনদের উপস্থিতিতে প্রবীণ শিল্পীকে সম্মানিত করা হয়।
ভীষ্ম গুহঠাকুরতা (Bhishma Guhathakurta)
মৃত্যু: ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অভিনেতা ভীষ্ম গুহঠাকুরতা। বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। সত্যজিৎ রায়ের গণশত্রু, শাখাপ্রশাখায় অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়াও তাঁর ছবির তালিকায় রয়েছে গুপী বাঘা ফিরে এল, অন্তর্ধান, বৈদুর্যরহস্য, বাঞ্ছারামের বাগান, হারমোনিয়াম, আতঙ্ক।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (Sandhya Mukherjee)
মৃত্যু: ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
দীর্ঘ লড়াই শেষে গত চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন 'গীতশ্রী' সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ৯০ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। গায়িকার মৃত্যু সংবাদ ট্যুইট করে জানান তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন। গানের সঙ্গেই কেটেছে তাঁর সারাটা জীবন। তাঁর গান যেন সন্ধ্যার মেঘমালা হয়েই চিরদিনের জন্য রয়ে গেছে বাঙালির হৃদয়ে। গানে গানেই তো তিনি শুনিয়েছিলেন ..‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া।’ সুরের রাজপথে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চিরকালের সাম্র্যাজ্ঞী। তাঁর গান অক্ষয়, অবিনশ্বর।
অভিষেক চট্টোপাধ্যায় (Abhishek Chatterjee)
মৃত্যু: ২৪ মার্চ, ২০২২
এই বছরই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন টলিউড অভিনেতা অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। শ্যুটিং চলাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বাড়িতে ফিরে শুরু হয় বুকে ব্যথা, কোনও রকমে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েন। পরদিন ভোরে নিথর অবস্থায় তাঁকে দেখেন বাড়ির লোকজন। বয়স হয়েছিল ৫৭। ১৯৮৬ সালে তরুণ মজুমদারের ছবি 'পথভোলা' দিয়ে সিনেমায় যাত্রা শুরু। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হল, 'দহন', 'বাড়িওয়ালি', 'মধুর মিলন' , 'মায়ের আঁচল', 'আলো','নীলাচলে কিরীটি'। শুধু বড় পর্দা নয় ছোট পর্দাতেও তিনি সমানভাবে সাবলীল অভিনয় করে দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছেন।
তরুণ মজুমদার (Tarun Majumdar)
মৃত্যু: ৪ জুলাই, ২০২২
টলিউডে আরও এক নক্ষত্র পতন ঘটে ৪ জুলাই। প্রয়াত হন প্রবীণ পরিচালক তরুণ মজুমদার। শেষ অবস্থায় রাখা হয়েছিল ভেন্টিলেশনে, গড়া হয়েছিল মেডিক্যাল বোর্ডও। কিন্তু সব চেষ্টা বিফলে যায়। শচীন মুখোপাধ্যায় ও দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে যাত্রিক গোষ্ঠীতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর। প্রথম ছবি উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘চাওয়া-পাওয়া’। এরপর একের পর এক হিট ছবি তরুণ মজুমদারের ঝুলিতে। ‘বালিকা বধূ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। শুধু ছবিই নয়, উপহার দিয়েছেন একের পর এক জুটি।
নির্মলা মিশ্র (Nirmala Mishra)
মৃত্যু: ৩০ জুলাই, ২০২২
২০২২ সালে সঙ্গীত জগতে আরও এক নক্ষত্র পতন হয়। আমাদের ছেড়ে যান, সঙ্গীতশিল্পী নির্মলা মিশ্র। তাঁর চিকিৎসক জানান, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়। ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’, 'ও তোতা পাখিরে'-র মতো জনপ্রিয় বাংলা গানের শিল্পী নির্মলা মিশ্র। মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা বসুর যুগে নির্মলা মিশ্রের গানও মন কেড়ে নেয়।
আরও পড়ুন: Aindrila Sharma: 'আরেকটু থাকতে দাও ওকে', সবাইকে অনুরোধ সব্যসাচীর
প্রদীপ মুখোপাধ্যায় (Pradip Mukherjee)
মৃত্যু: ২৯ অগাস্ট, ২০২২
দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস জনিত সমস্যায় ভুগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন 'জন অরণ্য' অভিনেতা প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। বিদায় নেন সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী চরিত্র 'সোমনাথ'। ১৯৭৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে প্রচারের আলোয় আসেন অভিনেতা। এরপর অজস্র ছবিতে কাজ করেন তিনি। ১৯৭৮ সালের 'গোলাপ বউ', ১৯৭৯ সালের দৌড়, ১৯৮১ সালের 'দূরত্ব' থেকে শুরু করে ১৯৯২ সালের 'হীরের আংটি', 'শাখা প্রশাখা', 'দহন'-এর মতো ছবিতে কাজ করেছেন।
ঐন্দ্রিলা শর্মা (Aindrila Sharma)
মৃত্যু: ২০ নভেম্বর, ২০২২
অবশেষে হেরে যান ঐন্দ্রিলা শর্মা। দীর্ঘ ২০ দিনের লড়াইয়ের পর মাত্র ২৪ বছরেই থেমে গেলেন তিনি। এক রবিবার দুপুরে তাঁর মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই তীব্র শোকের ছায়া নেমে আসে অনুরাগী এবং টলিউডের সহকর্মীদের মধ্যে। ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের লড়াই জিতে অভিনয়ে ফিরে এসে ফের অসুস্থ হয়ে পড়া। শেষ পর্যন্ত আর লড়াই করতে পারেননি অভিনেত্রী।
পল্লবী দে (Pallavi Dey), বিদিশা দে মজুমদার (Bidisha Dey Majumdar) ও মঞ্জুষা নিয়োগী (Manjusha Niyogi)
মৃত্য়ু: ১৫ মে, ২৬ মে ও ২৭ মে
তবে শুধু বার্ধক্যজনিত বা অসুস্থতায় মৃত্যুই নয়, এই বছর বাংলা বিনোদন জগত সাক্ষী থেকেছে একের পর এক অভিনেত্রী-মডেলের আত্মহত্যার ঘটনারও। যা নিয়ে তোলপাড় হয় বঙ্গ। এক মাসে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তিন তিনজন মডেল-অভিনেত্রীর দেহ উদ্ধার হয়। ১৫ মে পল্লবী দে-র দেহ মেলে। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই বিদিশা দে মজুমদারের দেহ উদ্ধার হয় ২৬ মে। ঠিক তার পরদিনই অর্থাৎ ২৭ মে, উদ্ধার হয় মঞ্জুষা নিয়োগীর দেহ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের এই চরম সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমীকরণ, কাজ না পাওয়া, হতাশা ইত্যাদিকেই দায়ী করা হয়।