শুভজিৎ সরকার: ভারত ধীরে ধীরে বিশ্বের একটি নতুন সম্ভাব্য অর্থনৈতিক পরাশক্তি (Superpower) হয়ে উঠছে। এখন অন্য একাধিক দেশের তুলনায় ভারতে অনেক বেশি পরিমাণে বিলিওনিয়ার তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে ইউনাইটেড কিংডমকে (UK) ছাড়িয়ে গিয়েছে। ২ সেপ্টেম্বর International Monetary Fund (IMF)  ঘোষণা করেছে যে ভারত ইউনাইটেড কিংডমকে (UK) ছাড়িয়ে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ এই ভারত, আমেরিকা এবং চিনের ঠিক পরে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে।


কোভিড-পরবর্তী যুগে, প্রকৃত জিডিপি (Real GDP) বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত প্রায় ৭.৭ শতাংশ গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বর্ষায় অসামঞ্জস্য এবং বিশ্বের সামগ্রিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাওয়ার কারণে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির এই গতি হ্রাস পেতে পারে। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার ঝুঁকির মধ্যে দাঁড়িয়ে রেটিং এজেন্সিগুলি ভারতের বৃদ্ধির সম্ভাবনাকেও কমিয়ে দিয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতি নিয়ে যে যে সমস্যাই থাকুক, গত এক দশকে কিন্তু ভারতীয় ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধিতে তার কোনও প্রভাব পড়েনি


২০২২ সালের ফোর্বস বিলিওনিয়ারদের তালিকা অনুযায়ী, ১৮ জন ভারতীয় ধনকুবের বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ বিলিওনিয়ারদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। বিশ্বের ২৬৬৮ ধনীতম ব্যক্তির মধ্যে, ভারতে ১৬৬ জন রয়েছেন, যা আমেরিকা এবং চিনের পরেই এই তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে।


বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ভারতীয়:
ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী ফরাসি ধনকুবের বার্নার্ড আর্নল্টকে (Bernard Arnault) সরিয়ে করে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি হয়েছেন।ফোর্বসের ধনকুবের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যানের মোট সম্পদ এখন ১৫৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১২.৩৭ লাখ কোটি টাকা)। আদানির মোট সম্পদ ৫.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেড়েছে, যা শতাংশের বিচারে ৩.৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি। তিনি ফরাসি ধনকুবের বার্নার্ড আর্নল্ট এবং অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের (Jeff Bezos) চেয়ে সামান্য এগিয়ে রয়েছেন। ধনীদের তালিকায় শীর্ষস্থান ধরে রেখেছেন টেসলার (Tesla) প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক (Elon Musk)।


দ্বিতীয় ভারতীয় ধনকুবের যিনি প্রথম ১০-এর তালিকায় রয়েছেন তিনি হলেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানি (Mukesh Ambani)। ফোর্বস (Forbes)-এ নথিভুক্ত আম্বানির মোট সম্পদ ৯২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আম্বানি ছাড়াও শীর্ষ দশের তালিকায় থাকা অন্য ধনকুবেরদের মধ্যে রয়েছেন বিল গেটস (Bill Gates), ল্যারি এলিসন, ওয়ারেন বাফেট (Warren Buffett), ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন (Sergey Brin)।


৩০ আগস্ট, গৌতম আদানি লুই ভিটন (Louis Vitton)-এর মালিক আর্নল্টকে ছাড়িয়ে বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি হয়েছিলেন। এটি প্রথম উদাহরণ ছিল যখন একজন এশিয়ান (Asian) শীর্ষ তিন বিলিওনিয়ারের মধ্যে স্থান পেয়েছিলেন। গৌতম আদানির এই উত্থান এককথায় অসাধারণ। বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি হয়ে ওঠার মাধ্যমে, আদানির উত্থানের যে উল্কাগতি দেখা গিয়েছে তা এর আগে কোনও ভারতীয় বা এশিয়ান কখনও অর্জন করতে পারেননি। ফোর্বসের মতে, আদানির সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাঁর সম্পদের অভাবনীয় বৃদ্ধি হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন কোভিড সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তখন আদানির সম্পদ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও কম ছিল। সেখান থেকে, তাঁর ব্যবসা প্রায় সব দিকে প্রসারিত হয়েছে আর তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ।


গৌতম আদানির উল্কার মতো উত্থান:
পরিকাঠামো ক্ষেত্রের (Infrastructure) একেবারে প্রথম সারির ব্যবসায়ী গৌতম আদানি (Gautam Adani) তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাতে ভারতের বৃহত্তম মুন্দ্রা বন্দর (Mundra Port) নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর আদানি গ্রুপ (Adani Group) পরিকাঠামো, পণ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদন-সংবহন এবং রিয়েল এস্টেটের মতো ক্ষেত্রে ব্যবসা করে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আদানি ভারতের দ্বিতীয় ব্যস্ততম মুম্বই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭৪ শতাংশ অংশীদারিত্ব অধিগ্রহণ করেছিলেন। এখন তিনি দেশের বৃহত্তম বিমানবন্দর অপারেটর। গৌতম আদানি বিশ্বের বৃহত্তম গ্রিন এনার্জি (Green Energy) উৎপাদনকারী হতে চান এবং তিনি বলেছেন যে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রকল্পগুলিতে ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করবেন৷
২০২২ সালের মে মাসে, তিনি সিমেন্ট ব্যবসায় ঢোকেন। ১০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে সুইস জায়ান্ট হলসিমের ভারতের সিমেন্ট ব্যবসা অধিগ্রহণ করেন ইনি। সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, আদানি গ্রুপ সম্প্রতি বাজার মূলধনের দিক থেকে টাটা গ্রুপকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আদানি গ্রুপের অধীনে থাকা সংস্থাগুলির সম্মিলিত বাজার মূলধন (Market Cap) ২১.১৪ লক্ষ কোটি টাকা, যেখানে টাটা গ্রুপের বাজার মূলধন ২১.০৪ লক্ষ কোটি টাকা।



মুকেশ আম্বানির সম্পদ:
অন্যদিকে, ভারতের অন্যতম শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি (Mukesh Ambani) ফোর্বসের তালিকা এবং ব্লুমবার্গ বিলিওনিয়ার সূচকে (Bloomberg Billionaires Index) অষ্টম স্থানে রয়েছেন। তিনি ১০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (রাজস্ব) রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের (Reliance Industries) সভাপতিত্ব করেন এবং পরিচালনা করেন, যার পেট্রোকেমিক্যাল, তেল ও গ্যাস, টেলিকম এবং খুচরা ব্যবসার টাইকুন। মুকেশ আম্বানির পিতা প্রয়াত ধীরুভাই আম্বানি একজন সুতো ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৬৬ সালে একটি ছোট টেক্সটাইল প্রস্তুতকারক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রিলায়েন্সের। ২০২২ সালে তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে, মুকেশ আম্বানি এবং তাঁর ছোট ভাই অনিল আম্বানি পারিবারিক সাম্রাজ্য ভাগ করে নেন। রিলায়েন্স ২০১৬ সালে ফোর-জি (4G) ফোন এবং ব্রডব্যান্ড পরিষেবা জিয়ো (Jio) লঞ্চের মাধ্যমে একটি টেলিকম মূল্য যুদ্ধের (Price War) জন্ম দেয়৷ এখন, এর ৪২ কোটিরও বেশি গ্রাহক রয়েছে এবং সারা দেশে ফাইভ-জি (5G) পরিষেবা চালু করার জন্য প্রস্তুত৷ তিনি রিলায়েন্সের ব্যবসাকে সবুজ শক্তির (Green Energy) দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এই সংস্থা আগামী ১০-১৫ বছরে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতে ৮০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।


রিলায়েন্সের শেষ এজিএম (AGM)-এ, আম্বানি তাঁর ব্যবসায় উত্তরাধিকারীদের আনার পরিকল্পনা করেছেন। ছেলে আকাশ এখন রিলায়েন্স জিওর চেয়ারম্যান, মেয়ে ইশা খুচরা ব্যবসার (Retail Business) তত্ত্বাবধান করে, আর ছোট ছেলে অনন্তকে নতুন শক্তি ব্যবসায় (Energy Business) যুক্ত করা হয়েছে।


আরও ভারতীয় ধনকুবের:
আদানি এবং আম্বানির পরে, ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সাইরাস পুনাওয়ালা (Cyrus Poonawala) ফোর্বসের তালিকায় ৬৪তম স্থানে রয়েছেন। পুনাওয়ালা ১৯৬৬ সালে সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (Serum Institute of India) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক (ডোজের হিসেবে) হিসাবে গড়ে তোলেন। এটি বছরে হাম, পোলিও এবং ফ্লু সহ বিভিন্ন ভ্যাকসিনের ১৫০ কোটি ডোজ তৈরি করে।
সিরামের সিইও সাইরাসের ছেলে আদর পুনাওয়ালা। তাঁর অধীনে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির জন্য একটি নতুন কারখানা তৈরি করতে সংস্থাটি ৮০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। সিরামের একাধিক Covid-19 টিকার অংশীদারিত্ব রয়েছে। এই সংস্থা কোভিশিল্ড (Covishield) তৈরি করে, যেটি AstraZeneca এবং Oxford University-এর যৌথ উদ্যোগে আবিষ্কৃত। ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার্স ইনডেক্স অনুসারে, পুনাওয়ালা একশোতম স্থানের নীচে রয়েছেন।


অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিল্পপতি যারা ধনী তালিকার শীর্ষ ১০০ জনের মধ্যে রয়েছেন তাঁরা হলেন এইচসিএল টেকনোলজিসের (HCL Technologies) চেয়ারম্যান শিব নাদার, ডিএমার্টের (DMart) প্রতিষ্ঠাতা রাধাকিশান দামানি এবং সাবিত্রী জিন্দাল, যিনি জিন্দাল গ্রুপের চেয়ারম্যান। কুমার বিড়লা, যিনি পণ্যের রাজা হিসাবেও পরিচিত, ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আদিত্য বিড়লা গ্রুপের প্রধান। সিমেন্ট এবং অ্যালুমিনিয়াম থেকে টেলিকম এবং আর্থিক পরিষেবাগুলিতে রয়েছে এই গ্রুপের ব্যবসা। ফোর্বসের মতে, ৬০টিরও বেশি ভারতীয় সংস্থা ২০২১ সালে  initial public offerings (IPOs)-এর মাধ্যমে ১৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন Nykaa-এর সিইও ফাল্গুনী নায়ার, যিনি তাঁর সংস্থার শেয়ার স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরে ভারতের সবচেয়ে ধনী মহিলা (Self Made) হয়ে উঠেছেন। ধনীদের তালিকায় রয়েছেন উদয় কোটাক, দিলীপ সাংভি, লক্ষ্মী মিত্তাল এবং আজিম প্রেমজি।

আরও পড়ুন: ধনী দেশগুলির টিকা-মজুত এবং কোভিডের লড়াইয়ে ভারতের টিকা-কূটনীতি