কাসোল রিভার সাইট ক্যাম্পের সামনে এসে গাড়ি যখন থামল, তখন বিকেল নামছে। নদীর শব্দ জানান দিচ্ছে খুব কাছেই তিনি বহাল তবিয়তে বিরাজমান। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে শেষ বিকেলের সূর্য অস্তাচলে। পিঠে বোঝাই করা কাঠ, আর দৈনন্দিন সামগ্রী নিয়ে ঘরে ফিরছেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। 


হঠাৎই রিভার সাইট ক্যাম্পে রাত্রিযাপনের সাধ জেগেছিল তিন কন্যার। সেই নেশাতেই ফেব্রুয়ারির শুরুতে বেরিয়ে পড়া। কলকাতা থেকে কালকা, সেখান থেকে সিমলা-কুলু-মানালি হয়ে শেষ দিনের ডেস্টিনেশন অচেনা কাসোল। আগে থেকে বুক করা গাড়ির ড্রাইভার চণ্ডীগড়ের বাসিন্দা, স্থানীয় না হওয়ার কারণে ক্যাম্পের রাস্তা ভুল হয়েছিল। বেশ খানিকটা ঘুরে অবশেষে পৌঁছনো গেল রিভার সাইট ক্যাম্পের সামনে। এখানেই চঞ্চলা পার্বতীকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে চারদিক থেকে আগলে দাঁড়িয়ে ধূসর পাহাড়। গায়ে শ্যাওলার চাদর।




দিল্লি থেকে কুলুর হয়ে ভুন্টার হয়ে রাস্তা গিয়েছে মণিকরণের দিকে। পাশে পাশে চলেছে পার্বতী নদী। রাস্তার নাম মণিকরণ রোড। মণিকরণ মন্দির থেকে চার কিলোমিটার গিয়ে পার্বতীর তীরেই সুন্দরী কাসোল।



নিরিবিলিতে পাহাড় ও নদীকে একসঙ্গে উপভোগ করতে চাইলে কাসোল অন্যতম সেরা ডেস্টিনেশন। ফি বছর বিশ্বের নানা প্রান্তের পর্যটক সমাগম হয় এখানে। ইজরায়েলি খাবার, জার্মান বেকারি এখানকার বিশেষত্ব। চলার পথে চোখে পড়বে হিব্রু ভাষায় লেখা সাইনবোর্ডও। এখানকার অধিবাসীরা অনেকেই ইজরায়েলি। হিমাচলের মিনি ইজরায়েল বলা হয়ে থাকে এই অঞ্চলকে। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এক সময়ে মানালিতে বসতি ছিল ইজরায়েলদের। তবে সেখানে পর্যটকদের ভিড় বাড়তে থাকায়, শহুরে কোলাহল ছেড়ে, স্থান পরিবর্তন করে পার্বতী নদীর তীরে পাইন ঘেরা এই অঞ্চলে এসে বসতি গড়েন শান্তিপ্রিয় ইজরায়েলরা।




এখান থেকেই গিয়েছে বেশ কয়কটি ট্রেকিং রুট। এ পথে পিন-পাবর্তী পাস, সারপাস ও তোষের পথে ট্রেকিং করা যায়। এ ছাড়াও বারসানা অবধি গিয়ে ওখানে থেকে চলে গিয়ে রয়েছে ক্ষীরগঙ্গা ট্রেকিং। এখানকার বেসক্যাম্পে থাকতে পারেন পর্যটকরা। ট্রেকিং পথে আপনার জন্য অপেক্ষায় অন্য অভিজ্ঞতা। ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে শান্তি নিবির গ্রাম। পথের প্রত্যেক বাঁকেই চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কাছেই রয়েছে ছোট্ট গ্রাম, তোষ। কাছাকাছি মালানা বলেও আরেকটি গ্রাম আছে। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন সেদিকেও। 


কাসোলে অনেক হোটেল রয়েছে। তবে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরতে থাকতে পারেন রিভার সাইট ক্যাম্পে। পার্বতীর তীরেই তৈরি হয়েছে অসংখ্য ক্যাম্প। সুন্দর করে সাজানো। সন্ধে নামতেই পরপর জ্বলে উঠে ক্যাম্পের আলোগুলো। নদীর তীর বরাবর রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্যাম্প। টিমটিম আলো, আর নদীর কলতান মিলেমিশে এক হয়ে রাত নামবে আপনার সামনে। আর যত দূর চোখ যাবে মনে হবে, যেন কেউ জোনাকির মালা গেঁথে পরিয়ে দিয়েছে পার্বতীর গলায়।




প্রত্যেকটি ক্যাম্পেই খাবারের সু-বন্দোবস্ত রয়েছে। আপনি চাইলে বন-ফায়ারও করতে পারেন। ক্যাম্পের লোকের সঙ্গে কথা বলে বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে দিলে ওঁরাই সব ব্যবস্থা করে দেবেন। নিরাপত্তা নিয়েও বিন্দুমাত্র আপোস করেননি ক্যাম্প পরিচালকরা। তাঁবুতে তালার ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকী সিসি ক্যামেরাও লাগানো রয়েছে এলাকায়। বাথরুম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গরম জলের ব্যবস্থা রয়েছে। 


একরাতের জন্য মাথাপিছু খরচ হতে পারে আনুমানিক ৩০০০ টাকা। কমপ্লিমেন্টরি ব্রেকফাস্ট পাবেন। দুপুর এবং রাতের খাবারের জন্য আলাদা টাকা দিতে হয়। তবে যাঁরা ক্যাম্পে খেতে চান না তাঁরা ৫০০ মিটার রাস্তা হেঁটে বাজারে গিয়ে খেয়ে আসতে পারেন। দু-একটা রেস্তরাঁও মিলতে পারে ক্যাম্পের ধারে-কাছে।




রাত বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে নদীর গর্জন। সে এক অন্য রোমাঞ্চ। তবে শীতকালে ক্যাম্পের রাত্রিযাপন এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। যাঁদের অভ্যাস নেই বা যাঁরা শীতকাতুরে তাঁদের পক্ষে বিষয়টি বেশ কঠিন। একেবারে শিয়রে নদী থাকার কারণে কার্যত হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় রাতের ঘুম উড়তে পারে। ফেব্রুয়ারিতেও ঠাণ্ডা ভালই। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি বরফের চাদরে ঢাকা থাকে কাসোল।


ফেব্রুয়ারির রাতের সে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতার পরশ পেয়েছিল তিন কন্যে। পাইন আর অচেনা গাছের আ-সবুজ আত্মীয়তা দু-হাতে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ওদের। শেষরাতে গল্প জমেছিল নদীর সঙ্গে। নির্জন, নিশ্চুপ কাসোল তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন, আর তার গা ঘেঁসে আপন খেয়ালে বইছে পার্বতী। প্রকৃতির নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে যেন বেজে চলেছে হ্যামলিনের সেই মন্ত্রমুগ্ধকর বাঁশির সুর। সবমিলিয়ে ডেস্টিনেশন ডাইরিতে কাসোল অন্য এক ভূ-স্বর্গের হাতছানি।