-মা, আজ যেতে হবে না ডিউটিতে। থেকে যাও না আমার কাছে।
-এ কেমন আবদার সোহিনী, তোমার মা সারাদিন তোমার কাছে বসে থাকলে, ওয়ার্ড ভর্তি রোগীদের কী হবে শুনি ?


সকাল সকাল কাজে বেরনোর সময়ে মেয়ের এমন আবদারে খানিক বিরক্তই হলেন উর্মিমালা। বকাও দিলেন মেয়েকে। কিন্তু সোহিনীর আজ মন খারাপ। ও জানে এই যে মা আজ বেরোবে, আবার দু-সপ্তাহ পর দেখা হবে ওর সঙ্গে। যদিও ছোট থেকেই পাঠ পেয়েছে সোহিনী। তাঁকে বোঝানো হয়েছে, দুর্গাপুজো হোক বা যে কোনও ছুটির দিন, এমনকী উইকেন্ডে মা-কে চাইলেই কাছে পাওয়া যাবে না। সব অক্লেশে মেনে নিয়ে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বেশ ম্যাচিওর সোহিনী। মায়ের জন্য খাবার থালা নিয়ে বসে অপেক্ষা করে সে। ক্লান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরলে জলের গ্লাস এগিয়ে দেয়। কোনও রোগী দীর্ঘ লড়াই-এর পর করোনা জয় করে ফিরল সে সব গল্পও জানতে চায় সে। আসলে সোহিনী জানে, মানিয়ে না নিয়ে উপায় নেই। কিন্তু ওই যে, মাঝে মাঝে ভীষণ বুঝদার মেয়েও বায়না ধরে। 'আজ না গেলেই হত না মা?' 


শহরের একটি সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী উর্মিমালা বন্দ্যোপাধ্যায়। 'টানা এক বছর করোনা ওয়ার্ডের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। বিধিনিষেধ মানতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়েই পরিবারের থেকে দূরে। রোজনামচার গল্প বলতে বলতে খানিক আক্ষেপের সুরেই বললেন, 'জানো তো, মেয়েটাকে ছুঁয়েই দেখা হয়নি বহুদিন।'


ওদিকে অন্য একটি হাসপাতালের আইসিইউ-র দায়িত্বে রয়েছেন সব্যসাচী রায়চৌধুরী। রোগীর চাপ সামলে বাড়ি ফেরা হয় না নিয়মিত। তাই সুযোগ পেলে আইসিইউ-তে বসেই ভিডিও কলে অঙ্ক বুঝিয়ে দেন ছেলেকে। খুদেও রোজ গল্পের পশরা সাজিয়ে অপেক্ষা করে বাবার জন্য। এমনই অনেক গল্প ছড়িয়ে রয়েছে মহামারির শহর জুড়ে। লকডাউন, অতিমারির জাঁতাকলে সন্তানের সঙ্গে কর্মরত বাবা-মায়ের দূরত্ব বেড়েছে। তবে 'পজিটিভ'-এ আতঙ্ক ছড়ালেও এই মুহূর্তে পজেটিভ থাকাই একমাত্র উপায়, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।


অতিমারি আবহে আমূল বদলে গিয়েছে দৈনন্দিন যাপন। খুদে মনে যার প্রভাব বিস্তর। লকডাউনের একঘেয়েমি আপনার সন্তানকে আরও জেদি, খিটখিটে স্বভাবের করে তুলতে পারে। তাই এই বদলাতে থাকা পরিবেশ আর বাবা-মায়ের সঙ্গে দূরত্ব সামলে খুদে মনের যত্ন অত্যন্ত জরুরি। শারীরিক দূরত্ব বাড়লেও মানসিক দূরত্ব যেন না বাড়ে, সেদিকেই গুরুত্ব দিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী বাবা-মা নন, অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত সব ব্যস্ত অভিভাবকরাই সতর্ক হন এখনই।


অতিমারি আবহে দূরে কর্মরতরা কীভাবে যুঝবেন খাঁচাবন্দি শৈশবের সঙ্গে ? পরামর্শ দিলেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ এবং মনোবিদ রিমা মুখোপাধ্যায়।



যোগাযোগ রাখুন নিয়মিত
পায়েল ঘোষ বলছেন, আপনি যত দূরেই থাকুন না কেন, ফোন, ভিডিও কল বা যে কোনওভাবে সেখান থেকেই সন্তানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। সামাল দেওয়া কঠিন নয়। কয়েকটা দিক মাথায় রাখলেই সহজ হবে পরিস্থিতি। 
 
খুদের অবদানও বৃহৎ
আপনার কর্মজীবন এগিয়ে নিয়ে যেতে, আপনার সন্তানের অবদান কতটা, সেটা ওকে জানান দিন। ওকে বোঝাতে হবে ও ছোট হলেও ব্রাত্য নয়। কঠিন এই পরিস্থিতিতে লড়াই করতে ওর ভূমিকাও যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা ওকে অনুভব করাতে হবে।


আলোচনা জরুরি
অতিমারি পরিস্থিতি নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলা জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনার সন্তানের মনে কী চলছে তা জানুন, মতামত নিন। কথার আদান-প্রদান চলুক। দিনের অন্তত যে কোনও একটি সময়ে আপনার সন্তানের সঙ্গে বসে প্রাণখোলা হাসির গল্প করুন। ওদের মনের উদ্বেগ কাটাতে হবে আমাদেরই। চিকিৎসক বাবা-মায়েরা যেসব ইতিবাচক ঘটনার সাক্ষী থাকেন, বাড়ি ফিরে অথবা দূর থেকেই ওকে সে সব গল্প শোনান।


হাসি মুখে সামাল দিন
অভিভাবকের হাসিমুখ বাচ্চাদের মনের উদ্বেগ কমাতে ভীষণ সাহায্য করে। তাই চেষ্টা করুন নিজের মনের আলোকিত অংশটা ওদের সামনে তুলে ধরতে। দুঃখ, হতাশা, রাগ ওদের সামনে না আনাই ভাল। কঠিন পরিস্থিতিও লঘু করে দেখান ওকে। যুদ্ধ জয়ের পাঠ দিন। দিনের শেষে সন্তানের হাসিমুখ আমাদের মনের ভারও লাঘব করবে অনেকটা।


চাপিয়ে নয়, বুঝিয়ে বলুন
'স্যানিটাইজেশন', 'অনলাইন ক্লাস', 'কোয়ারেন্টাইন', 'আইসোলেশন', 'লকডাউনের' মতো ভারী শব্দগুলো ওর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আগে ওকে বোঝান। চারপাশে কেন এই আমূল বদল সেসব ছোটদের বুঝিয়ে বলা জরুরি।


প্রায়োরিটি সেটিং দরকার
অনেক কাজের শেষে বাড়ি ফিরে ওই সময়ে ফোন, মেসেজ বা বাইরের কাজ বন্ধ রেখে সময়টুকু শুধু ওকেই দিন। বুঝিয়ে দিন, আপনার প্রায়োরিটির তালিকার শীর্ষে রয়েছে আপনার সন্তানই। আপনাকে দীর্ঘ সময়ে কাছে না পেয়ে  না পেয়ে ওর মনে মধ্যে যেসব প্রশ্ন জমেছে, সব প্রশ্নের উত্তর ওকে দিন।


বিশ্বাসযোগ্য সঙ্গ দরকার
যে সময়টা আপনি দূরে, যাঁর কাছে ওকে রেখে যাচ্ছেন সে কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটা খেয়াল রাখুন। দিনের বেশিরভাগ সময়টা আপনাকে ছাড়া কার কাছে থাকছে, কী শিখছে তা গুরুত্বপূর্ণ।


বিকল্প নিয়ে সতর্ক হন
অতিমারির সময়ে ব্যস্ত বাবা-মাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন মানুষের বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট স্থান না পায়। দূর থেকেই নিয়ন্ত্রণ রাখুন এই দিকটায়। ওর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হন। মাঝে মধ্যে বাবা-মা এবং সন্তান সকলেরই কাউন্সেলিং দরকার। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।


এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মনোবিদ রিমা মুখোপাধ্যায় বলছেন, বয়স অনুযায়ী সন্তানের মানসিক চাহিদা বুঝতে হবে। খুব ছোট বাচ্চারা সবসময়ে বাবা-মাকে কাছে চাইলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের ব্যক্তিগত পরিসরের গুরুত্ব বদলাতে শুরু করে। ওরা নিজস্ব সময় চায়। তবে চাহিদা বুঝে সামঞ্জস্য বজার রাখতে হবে অভিভাবকদেরই। কর্মরত বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে যা বেশিরভাগ সময়েই কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও একটু সতর্ক হলেই সামাল দেওয়া যায় পরিস্থিতি। 




প্র: ব্যস্ত থাকি, সন্তানকে  সময় দেব কীভাবে?
যে সমস্ত অভিভাবক সন্তানদের কোয়ান্টিটি টাইম দিতে পারছেন না, তাঁরা অন্তত কোয়ালিটি টাইম দিন। দূরে থাকাকালীন ফোন, হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করুন। দূরে থেকেই ওর সমস্যাগুলো শুনুন। সমাধানের চেষ্টা যে করছেন সেটা ওকে বোঝান। 


প্র: ভিডিও কলে সব বোঝা সম্ভব?
মায়েরা সন্তানদের ভাব-ভঙ্গির পরিবর্তন বুঝতে পারে মুখ দেখেই। এ ক্ষেত্রে ওর চোখ-মুখে বা আচরণের পরিবর্তন হলেই ওকে বারবার প্রশ্ন করুন। 


প্র: খুব সামান্য বিষয় নিয়েও কাজের মাঝে বারবার ফোন করে, কী ভাবে সামলাব?
সন্তান ঘন ঘন ফোন করলে ওর ওপর বিরক্ত হবেন না, এই সময়গুলো ওর কথার গুরুত্ব দিন, নিজে না পারলেও তৎক্ষণাৎ ওর পাশে থাকতে পারে এমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আপনি দূরে থাকলেও যে ওর মানসিক অবস্থার গুরুত্ব যে আপনার কাছে রয়েছে সেটা ওকে অনুভব করানো জরুরি। 


ব্যস্ত বাবা-মাকে আর কী কী পরামর্শ দিলেন মনোবিদ রিমা মুখোপাধ্যায়


বাবা-মা-এর জন্যও চিন্তা করে সন্তানরা। প্রকাশ করতে না পারলেও, মনের ভিতর চলতে থাকে অস্থিরতা। ওর মানসিক অবস্থার দিকে সময় পেলেই নজর দিন। 



  • নিজের কাজের ভাল-মন্দ সন্তানের সঙ্গে শেয়ার করুন।

  • আমি শারীরিকভাবে দূরে থাকলেও যে বাচ্চার কাছেই রয়েছেন, সেটা ওকে বারবার অনুভব করান। 

  • বাড়িতে কাদের কাছে সন্তানকে রেখে যাচ্ছেন সেদিকে সচেতন হওয়া জরুরি। বাড়ির সকলকে ওর মানসিক পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। 

  • বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখুন, যাতে ও মনের কথা আপনাকে বলতে ভয় না পায়।

  • বয়স অনুযায়ী সন্তানের অ্যাক্টিভিটি সেট করুন। ওকে নিজের জগতে ব্যস্ত রাখুন। সকাল থেকে ওকে কয়েকটা কাজ দিয়ে রাখুন। 

  • পরিস্থিতি জটিল হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

  • বাচ্চার নালিশ খুব বোকা বোকা হলেও, সেটা শুনুন দূর থেকেই। ওর সমস্যাটাও যে আপনার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ সেটা ওকে জানান দিন।

  • অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা ব্যস্ত রয়েছে ধরে নিয়ে সন্তানরা যোগাযোগ কমিয়ে দেয়, গুটিয়ে নেয় নিজেকে। সে ক্ষেত্রে আপনি নিজে থেকে ওর সঙ্গে কথা বলুন, এবং এটা বুঝিয়ে দিন যে ওর জন্য আপনি রয়েছেন।

  • বাবা অথবা মা, একজন ব্যস্ত থাকলে অন্যজন সন্তানকে সময় দিন।


সব শেষে পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের কথায়, 'অভিভাবকদের বকুনির মধ্যে লুকিয়ে থাকা যত্ন ও ভালবাসা সন্তানরা অনেকসময়ই বুঝতে পারে না। ফলে তাদের মনে অভিভাবকদের প্রতি তৈরি হয় রাগ বা অভিমান। তাই সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের নিঃশর্ত ভালোবাসার প্রকাশও অবশ্যই প্রয়োজন।'


মহামারি পরবর্তী পৃথিবী তো আপনার সন্তানের জন্য রইলই। তার আগে এই সময়টার সঙ্গে লড়াই চলুক একসঙ্গে। দূরে থেকেও বাবা-মায়ের মনের বাঁধন মজবুত হোক আপনার সন্তানের সঙ্গে।