কলকাতা: রাখী পূর্ণিমা বা রক্ষাবন্ধন । ঝুলন পূর্ণিমার পুণ্য তিথিতে ভারতজুড়ে এই উতসব শুধুমাত্র ভাইবোনের সম্পর্কের উদযাপন নয়, একে অন্যকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মুহূর্ত। শিকড় খুঁজতে গেলে ইতিহাস ও কিংবদন্তী একাকার হয়ে যায়। ভারতের পুরাণ, মহাকাব্য থেকে ইতিহাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রক্ষাবন্ধনের গল্প। সেই রাখী কখনও এসেছে ভাই বোনের চিরন্তন সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে। কখনও আবার প্রেমিকা বেঁধে দিয়েছেন চিরতরে প্রিয়জনকে বেঁধে রাখার সুতো। যুগ অনুসারে রাখীর নাম বদলে গেছে। মহাকাব্য, পুরাণ, ইতিহাসে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রাখীবন্ধন সংক্রান্ত যে কাহিনিগুলি উঠে এসেছে, তা বেশির ভাগই বহুশ্রুত ও প্রচলিত। ইতিহাস বই ঘেঁটে এর সত্যতা যাচাই করলে হয়ত মিলবে না অনেক তথ্যই।
ডেকরেটেড রাখীর যুগে মনে রাখা ভাল, রাখী কিন্তু আদতে একটি সুতো। যে সুতো বেঁধে দেওয়ার মধ্যে থাকে প্রতিশ্রুতি রক্ষার শপথ। মহাভারতে কথিত আছে, মা কুন্তী যখন কর্ণকে জন্মের পর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন সদ্যোজাতের হাতে বেঁধে দিয়েছিলেন তাগা। এই তাগার মধ্যে হয়ত ছিল সন্তানকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করার শক্তি।
মহাভারতে রাখীবন্ধনের আরও একটি গল্প খুবই লোকমুখে ফেরে। মহাভারতে শিশুপালের দিকে সুদর্শন চক্র ছুড়ে দেওয়ার সময় কৃষ্ণের হাতের আঙ্গুল কেটে রক্ত বের হতে শুরু করে। কৃষ্ণসখী দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে তাঁর হাতে বেঁধে দেন। সেই থেকেই শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। যখন ভরা রাজ সভায় দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে মেতে উঠেছিল, সেই সময় ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভাব ঘটে পার্থসারথিরই। দ্রৌপদীর লজ্জানিবারণ করেন চিরসখা।
রামায়ণের একটি গল্প আবার লোকমুখে ফেরে। মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমে রাম-সীতার দুই সন্তান লব-কুশের জন্মের পর তাদের হাতে কুশের অগ্রভাগ ও নিম্নভাগ বেঁধে দেন ঋষি। সেও তো একরকম রক্ষা বন্ধনই। পুরাণে অনেক মাকেই শোনা যায়, সন্তানের মঙ্গলকামনায় সুতো বেঁধে দিতে। তবে তা যে রাখীবন্ধনের তিথি-লগ্ন বেঁধেই ঘটে এমনটা নয়।
রাখীবন্ধন উত্সবে একটি পৌরাণিক গল্পে কথিত আছে, দৈত্য রাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত । তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বৈকুণ্ঠ ছেড়ে কৃষ্ণ বাস করতে শুরু করেন রাজপ্রাসাদে। কিন্তু তাতে মহালক্ষ্মীর মন ভাল নেই। তিনি কী করেন। ছদ্মবেশে হাজির হন বলির প্রাসাদে। বিষ্ণু-পত্নী রাজাকে বলেন তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ । তিনি অনুরোধ করেন যতদিন না, তাঁর স্বামী ফিরে আসেন ততদিন যেন বলিরাজা যেন তাঁকে আশ্রয় দেন । শ্রাবণ পূর্ণিমায় তাঁর হাতে রাখী বেঁধে দেন লক্ষ্মী। আপ্লুত হয়ে যখন বলিরাজা জানতে চান, তাঁর কী প্রার্থনা, তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন বিষ্ণুকে ফিরিয়ে দিতে। এরপর বলিরাজের প্রাসাদ থেকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যান বিষ্ণু।
রাখীবন্ধনের সঙ্গে মা সন্তোষীর উপাখ্যানের একটি যোগ আছে। কারও কারও বিশ্বাস, রাখী উত্সবের দিন গণেশের বোন তাঁর হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। এতে গণেশের দুই ছেলের মন খারাপ হয়। তাদের কোনও বোন ছিল না। তারাও তখন বাবার কাছে বোন পাওয়ার আশায় বায়না ধরে। গণেশ তখন তাঁর দুই ছেলের মন ভাল রাখার জন্য হোমাগ্নি থেকে এক কন্যার জন্ম দেন। এই দেবীই নাকি গণেশ-কন্যা সন্তোষী মা। সন্তোষীই পরবর্তীতে গণেশের দুই পুত্রের হাতে বেঁধে দেন রাখী।
এছাড়াও পুরাণজুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা কাহিনি। তবে সর্বোপরি রাখী হল বন্ধনের উত্সব। প্রতিশ্রুতি রক্ষার উত্সব। তা ভাইবোনের মধ্যেই হোক কিংবা প্রিয় দুই মানুষের মধ্যে। সেই জন্যই তো প্রেম পর্যায়ের গানেও রবি ঠাকুর লিখেছেন ... '' মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো আমার হাতের রাখী-- তোমার কনককঙ্কণে॥