কলকাতা: ঘরে বসে জানলার কাচে চোখ রেখে বা ছবির মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের শোভা দেখতে চান?এমন একটা জায়গায় থাকতে চান, যেখানে আপনি ওপরে, মেঘের দল নিচে? ভাসতে ভাসতে যখন-তখন মেঘ এসে আপনাকে ঢেকে দেবে, দরজা খোলা থাকলে ঘরে ঢুকে পড়বে মেঘ! শহরের কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃত শান্তি যদি চান, এবারের পুজোয় দলবেঁধে চলে যান চিসাং। পরিবারের লোকজন বা বন্ধুদের সঙ্গে অনাবিল আনন্দে দু-তিনদিন কাটিয়ে আসতে পারবেন। আর যদি দম্পতি হন, তাহলে চিসাংয়ের চেয়ে ভাল জায়গা খুব কমই আছে। প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্যের মাঝে একে অপরকে আবিষ্কার করার সুযোগ পাবেন। চিসাংয়ে বিএসএনএল ছাড়া অন্য কোনও নেটওয়ার্ক কাজ করে না। ফলে মোবাইল ফোন শুধু ছবি তোলা বা গেম খেলার জন্য ব্যবহার করতে পারেন। ইন্টারনেট, ফোন কল, মেসেজ থেকে কয়েকদিনের জন্য বিরতি।




চিসাং নামটা হয়তো অনেকের কাছেই অপরিচিত। কারণ, এখানে পর্যটন শুরু হয়েছে বছর তিনেক হল। তবে এই পাহাড়ি জায়গাটা খুব দূরে নয়, আমাদের রাজ্যের মধ্যেই। কালিম্পং জেলার মধ্যে হলেও, মালবাজার হয়ে যাওয়া সহজ। ডুয়ার্সের পাশেই এই অপূর্ব জায়গাটা। নির্জনতা আসলে কী, সেটা যদি ভালভাবে উপলদ্ধি করতে চান, তাহলে চিসাং যেতেই হবে। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে শুধু দুটো বাড়ি, একটাই পরিবারের বাস। এছাড়া আর কোথাও লোকজন চোখে পড়বে না। পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চোখ টেনে নেবে নানা ধরনের গাছ, ফুল। দূরে দেখা যাবে মেঘে ঢাকা উপত্যকা, শোনা যাবে খরস্রোতা নদীর উদার আহ্বান। গাছের সারির মধ্যে দিয়ে অনেক নিচে নামলে তবে দেখা মিলবে নদীর। ১৫ মিনিট চড়াইয়ে উঠলেই রাস্তা শেষ। জিরো পয়েন্টে ওঠার এই রাস্তাটা প্রকৃতিদেবী যেন নিজের হাতে সাজিয়েছেন। না গেলে বিশ্বাস করা যাবে না, গ্রামের পথ এত সুন্দর হয়।


মালবাজার থেকে চাপড়ামারি অভয়ারণ্যের পাশ দিয়ে চিসাং যাওয়ার রাস্তাটাও অপূর্ব। সমতল পার করে পাহাড়ি পথ শুরু হতেই একের পর পর ঝর্ণার পাশ দিয়ে ছুটে চলে গাড়ি। অনেক জায়গায় তো রাস্তার ওপর দিয়েই বয়ে চলেছে স্রোত। জলের ওপর দিয়েই চলে গাড়ি। তবে অন্যান্য পাহাড়ি পথে যেমন একের পর এক বাঁক থাকে, চিসাং যাওয়ার রাস্তা তেমন নয়। এ পথে বাঁক কম। পাহাড়ের মানুষের মনের মতোই সরল পথ। চিসাংয়ের উচ্চতাও খুব বেশি নয়। ফলে শ্বাসকষ্ট হওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কম। যাঁদের হার্টের সমস্যা আছে, তাঁরাও একটু সাবধানতা অবলম্বন করে অনায়াসেই ঘুরে আসতে পারেন।


চিসাংয়ে যেখানে থাকবেন, তার সামনেই ভুটান পাহাড়। মেঘ সরে গেলেই বিদেশ ভ্রমণের অনুভূতি হয়। ভুটানের সেনাবাহিনীর ছাউনি চোখে পড়ে। পাহাড়ের কোলের বাড়িঘরও দেখা যায়। কেউ যদি ট্রেকিং করতে চান, তাহলে চিসাং থেকে রাচেলা পাস যেতে পারেন। যাঁরা ট্রেকিং করতে চান না তাঁরা গাড়ি নিয়ে দাওয়াই খোলা,জলঢাকা নদী, তোড়ে বাজার, বিন্দু, ঝালং, সুনতালেখোলা, সামসিং, রকি আইল্যান্ড, দলগাঁও ঘুরতে পারেন। যদি ট্রেনে ফেরেন, তাহলে চিসাংয়ে দু’দিন থেকে হেঁটে চারপাশ দেখে নিয়ে ফেরার দিন সকালে গাড়ি নিয়ে তোড়ে বাজারের দিক থেকে শুরু করে পরপর সব জায়গাগুলো দেখে মালবাজার চলে আসতে পারেন। বিন্দু জলাধারের পাশের দোকানগুলো থেকে নানারকম চকোলেট আর ছাতা কিনতে পারেন। রকি আইল্যান্ডে খরস্রোতা নদীতে স্নান করতে পারেন, তবে সতর্কভাবে। কারণ, পাহাড়ি নদীর জল হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে বিপদ ডেকে না আনাই ভাল।


বাঙালির বেড়ানোর অন্যতম আকর্ষণ হল খাওয়া। তাই চিসাংয়ের এত কথা বলার পর খাওয়ার বিষয়ে কিছু না বললে ভ্রমণকাহিনি অসমাপ্ত থেকে যাবে। চিসাংয়ে যে হোম স্টে-তে থাকবেন, সেই পরিবারের আতিথেয়তার তুলনা নেই। ওঁরা যাবতীয় কাজ নিজেরা করেন। নিজেদের চাষের জমিতে অর্গ্যানিক শাক-সবজি রান্না করে দেন অতিথিদের। সকালে চা, বিস্কুট, পুরি-সবজি, দুপুরে নিজেদের বানানো আচার, পাঁপড়, ভাত, ডাল, শাক, নানারকম সবজি, ডিম, সন্ধেবেলা মোমো, পকোড়া, রাতে মাংস-ভাত বা রুটি পাওয়া যায়। বর্ষার সময়টা বাদ দিয়ে বছরের বাকি সময়ে বার্বিকিউও করা যায়। নদীর ধারে পিকনিকও করা যেতে পারে।


‘হত্যাপুরী’ উপন্যাসে পুরীর নীলাচল হোটেলকে সিক্স স্টার আখ্যা দিয়েছিলেন জটায়ু। চিসাং হোম স্টে-র ডাইনিং স্পেসকেও অনায়াসেই ছয় বা সাত তারা বলাই যায়। দোতলায় কাঠের ঘরে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা। জানলার পাশে পরপর টেবল সাজানো। জানলার বাইরে তাকালেই পাহাড়। জানলা খোলা থাকলে ঘরে ঢুকে পড়ে মেঘ। স্বপ্নের মতো জায়গা।


কীভাবে যাবেন?


শিয়ালদা থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে নিউ মাল জংশনে নেমে গাড়িতে চিসাং ঘণ্টাদুয়েকের পথ। ফেরার সময় নিউ মাল জংশন থেকে শিয়ালদা আসার জন্য কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসই ধরতে পারেন।


কোথায় থাকবেন?


চিসাংয়ে থাকার জন্য একটাই হোম স্টে আছে। নাম দ্য ওয়াইল্ডউডস রিট্রিট (The Wildwoods Retreat)। ওয়েবসাইট দেখে নিয়ে ফোনে বুকিং করতে পারেন। ৫০ শতাংশ টাকা আগে পাঠিয়ে দিতে হয়, বাকি টাকা ওখানে গিয়ে দিতে হয়। কার্ডে পেমেন্ট করার উপায় নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক যেহেতু কাজ করে না, ফলে ইউপিআই ট্রান্সফারও করা যাবে না। ক্যাশই দিতে হবে। বড়দের থাকা-খাওয়া নিয়ে প্রতিদিন খরচ ১,৫০০ টাকা (জিএসটি অতিরিক্ত), বাচ্চাদের খরচ কিছুটা কম। নিউ মাল থেকে চিসাং যাওয়ার গাড়ি ভাড়া ২,৫০০ টাকা। সাইট সিইং সেরে নিউ মাল ফিরতে চাইলে খরচ ৩,৫০০ টাকা।


কী কিনবেন?


চিসাং হোম স্টে-তে ভাল চা, ন্যুডলস, কাঠের তৈরি ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, ঝুড়ি, বাচ্চাদের খেলনা পাওয়া যায়।