করোনা আতঙ্ক ছিলই। দোসর হল আরও নানারকম ভাইরাসের দাপট। সেই সঙ্গে আবার স্ক্রাব টাইফাস বাড়াল দুশ্চিন্তা। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর থেকে দক্ষিণ, একের পর এক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ভর্তি হয়ে যাচ্ছে জ্বরে আক্রান্ত শিশুতে। কোথাও কোথাও শিশু হাসপাতালের সব বেডই প্রায় ভর্তি। এদের সবারই শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা তো আছেই। সেই সঙ্গে কারও বমি, কারও পেটের সমস্যা, কারও আবার শ্বাসকষ্ট। প্রত্যেকের জ্বরের কারণযে একই তা নয় কিন্তু! পরীক্ষায় মিলছে নানা কারণ, কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, কেউ নিউমোনিয়ায়, কারও আবার স্ক্রাব টাইফাস। কারও কারও জ্বরের কারণ আবার ভাইরাস। সবমিলিয়ে এক সঙ্গে অগুনতি শিশু অসুস্থতার কবলে।
জেলা- জেলা থেকে আসছে শিশু মৃত্যুর খবরও। করোনার তৃতীয় ঢেউতে শিশুরা বেশিরকম আক্রান্ত হবে কিনা এই নিয়ে আলোচনা চলছে বহুদিন থেকেই। এরই মধ্যে জানা-অজানা কারণে কাতারে কাতারে শিশুর জ্বর আশঙ্কা বাড়িয়েছে অভিভাবকদের। সবথেকে বড় কথা হল, জ্বর থেকে নিউমোনিয়াও হচ্ছে। কিন্তু জ্বরের পিছনে কারণ কী ? অন্যান্য ভাইরাসের সংক্রমণ এড়িয়ে চলার উপায়ই বা কী, সবকিছু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জয়দেব রায়।
এই সময় শিশুদের জ্বরের কারণগুলি কী কী -
- ডেঙ্গু
- স্ক্রাব টাইফাস
- ভাইরাল ফিভার
ডা. রায় জানালেন, শিশুদের মধ্যে যারা জ্বর ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আসছে, তাদের বেশিরভাগের কোভিড টেস্টের নেগেটিভ রিপোর্ট আসছে। তাই প্রথমেই আশ্বস্ত করা দরকার, এই জ্বরের সঙ্গে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। করোনা যেমন একরকম ভাইরাস, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ঘায়েল করে, তেমন করোনা ছাড়াও অন্যান্য ভাইরাসের প্রকোপেও জ্বর-জারি, এমনকী নিউমোনিয়া পর্যন্ত হতে পারে, যা দেখা যাচ্ছে এখন। এখন যে ভাইরাসগুলি শিশুশরীরে ঢুকে সমস্যা তৈরি করছে, তা মূলত,
- ইনফ্লুয়েঞ্জা এ অ্যান্ড বি (Influenza A & B)
- রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস (Respiratory Syncytial Virus)
- প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, ( Parainfluenza)
- মেটানিউমোভাইরাস (metapneumovirus)
কোভিড নেগেটিভ হওয়া সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে শ্বাসকষ্ট বেশ তীব্র। আগে দেখা যেত এইসব ভাইরাসের দাপট আগে শীতে বেশি হত, কিন্তু এই ঋতুতে এত দাপট আগে দেখা যায়নি। অ্যাডিনো ভাইরাস বড়দের ক্ষেত্রে ততটা ভয়ঙ্কর না হলেও বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকারক হতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেককে অক্সিজেন সাপোর্ট তো দিতেই হচ্ছে, দিতে হচ্ছে PICU (পিডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট)ও দিতে হচ্ছে ভেন্টিলেটর সাপোর্টও।
এর উপসর্গগুলি কী কী ?
- প্রথম দিকে সর্দি-কাশি হচ্ছে।
- পরে শ্বাসকষ্ট বা অন্যান্য সিম্পটম দেখা যাচ্ছে। উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ দিতে হচ্ছে।
- ভাইরাস প্রকোপ বাড়িয়ে ফুসফুসে ছড়াচ্ছে করোনার মতো। অনেক ক্ষেত্রেই এর ফলে ফুসফুসের শিরা - ধমনীতে স্প্যাসম দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ রেসপিরেটরি ট্র্যাকে প্যাজম হয়ে নালীটা সরু করে দিচ্ছে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বাড়ছে। তখন অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ছে।
- জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৫-৬ দিন ভোগার পর এমনটা হচ্ছে।
- বাচ্চা নেতিয়ে পড়ছে।
- খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। হাঁপিয়ে উঠছে।
চিকিৎসা
- ২-৩ দিনের জ্বর যদি না কমে ও অবস্থা অবনতি হয়, তবে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
- পাঁজরার হাড় যদি ভিতরের দিকে ঢুকে যায় তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
- দ্রুত চিকিত্সার ব্যবস্থা করতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে, প্রথমে আক্রান্তদের ওষুধ, ফ্লুইড দেওয়া হচ্ছে।
- দরকারে অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপতে হবে অক্সিমিটার দিয়ে। যদি অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমেই নামতে থাকে, তাহলে বাইরে থেকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া জরুরি।
- ওষুধ যাতে দ্রুত কাজ করা শুরু করে, তাই নেবুলাইজার ব্যবহার করে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।
- প্রয়োজনে পিডিয়াট্রিক ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সংক্রমণ আটকাবেন কী করে -
এক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা একটাই কথা বলেন, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিয়র। যেহেতু এই মুহূর্তে শিশুদের স্কুল খোলেনি, তাদের বাইরে বেরনো বা মেলামেশার পরিধি খুবই কম। তাই পরিবারের মানুষদেরই সতর্ক হতে হবে।
- বারবার হাত-মুখ ধুতে হবে। বড়রা যাঁরা বাইরে বের হচ্ছেন, তাঁরা ভাল করে স্যানিটাইজ করে তবেই বাচ্চাদের কাছে যান।
- বড়রা সর্দি কাশি হলে বাচ্চাদের কাছে যাবেন না।
- শিশুদের অবশ্যই সময় মতো, চার্ট মেনে ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়ান। তাতে করোনা না আটকালেও জেনারেল ইনফ্লুয়েনঞ্জা তো আটকাবেই!
- ফ্লু ভ্যাকসিন বাচ্চার ৬ মাস বয়স থেকেই নেওয়া যায়। তখন যদি নেওয়া নাও হয়ে থাকে, তবে বড় হয়েও বাৎসরিক একটি করে জ্বরের ভ্যাকসিন নেওয়া যায়। এতে ইনফ্লুয়েঞ্জা ফিভার আটকায় ঠিকই, তবে অন্যান্য ভাইরাস আটকানোর মতো ভ্যাকসিন এখনও বের হয়নি।
- প্রয়োজনে এমন হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার, যেখানে PICU আছে।
- এছাড়া দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যেসটা জারি রাখতে হবে।
- হাঁচি পেলে বড়রাও যেমন মুখ ঢেকে হাঁচেন, তেমন অভ্যেস বড়দের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদেরও করতে হবে।
- সেই সঙ্গে এঁঠো খাবার দাবার ভাগাভাগি করে না খাওয়ার অভ্যেস করা দরকার।
তবে সবার আগে মনে রাখতে হবে, শিশুর জ্বর হলে বাড়িতে ফেলে রাখবেন না বা নিজে চিকিৎসা করার চেষ্টা করবেন না। হাসপাতালে নিয়ে যান কাল বিলম্ব না করেই।