কলকাতা: একবিংশ শতকে যে যুগে দাঁড়িয়ে আমরা সেখানে সার্চ হয়ে ভয়েস মেসেজে, প্রশ্ন বললে গোটা উত্তর লিখে দেয় হালের চ্যাটজিপিটি। ৪জি-কে টপকিয়ে বাজার মাতাচ্ছে আধুনিক ৫-জি। কিন্তু শুভসময় থেকে তিথি, নক্ষত্র, রাশিফল, বাঙালির ভরসা যেখানে, তা পঞ্জিকা। হোক না তা সস্তা কাগজে ছাপা, গোলাপি পাতায় মোড়া। আবেগে জড়ানো 'ফুলপঞ্জিকা' আজও নববর্ষের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
পঞ্জিকার সেকাল
এখনও অনেক বাঙালির দিন শুরু হয় পঞ্জিকা ধরে, বছর শেষও হয় পঞ্জিকার শেষ পৃষ্ঠা উল্টিয়ে। যদিও এখন নতুন বছর শুরুর অনেক আগেই বাজারে চলে আসে আগামী বছরের পঞ্জিকা। তবে নববর্ষের দিনই পঞ্জিকা কেনার রীতি এখনও রয়েছে। ইতিহাস বলে, বাংলায় প্রথম পঞ্জিকার প্রচলন করেছিলেন কৃষ্ণনগর নিবাসী রঘুনন্দন। তিনি ছিলেন সেসময়ের ব্রাহ্মণ এবং পণ্ডিত ব্যক্তি। মানুষ শুভক্ষণের সন্ধান নিতে দ্বারস্থ হতেন তাঁর কাছে। যদিও পরবর্তীতে তাঁর গণনায় কিছু ভুলত্রুটি পাওয়া গিয়েছিল। পরে নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামচন্দ্র বিদ্যানিধিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশের।
পঞ্জিকাতে মুঘল-ছোঁয়া
'বাঙালির ঐতিহাসিক অভিধান'-এ বলা হয়েছে, বাংলা ক্যালেন্ডার মূলত তৈরি করা হয়েছিল সংস্কৃত জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’র উপর ভিত্তি করে। তবে মুঘলদের ব্যবহৃত ইসলামিক হিজরি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে এদেশের সন-হিসেব না মেলায় আকবর জারি করেন, নতুন ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করতে হবে। সেকিই মতো নতুন ক্যালেন্ডারে মিশে গিয়েছিল ইসলামি ক্যালেন্ডার, সূর্য সিদ্ধান্ত এবং আকবরের রাজত্বের তারিখ।
পঞ্জিকা একাল
বাংলায় দু'ধরনের পঞ্জিকার প্রচলন রয়েছে। একটি গুপ্তপ্রেসের পঞ্জিকা। যা বেনিয়াটোলা লেন থেকে প্রকাশ হয়ে চলেছে। প্রায় এক শতাব্দী ধরে দুর্গাচরণ গুপ্তের বংশধররা এই পঞ্জিকা প্রকাশ করে আসছে বলে জানা যায়। আরেকটি, কবিরাজ স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা।
অজানা পঞ্জিকা
ইংরেজদের আমলেও এই পঞ্জিকার কিন্তু বেশ রমরমা ব্যবসা ছিল। জানা যায়, ইংরেজরা ১৮৬৭ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে যেসব বাংলা বই পাঠিয়েছিল, তার মধ্যে ১২টি ছিল এই পঞ্জিকাই। পাশাপাশি জেমস লংয়ের একটি লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৫৭ সালে কলকাতার বাজারে প্রায় এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার পঞ্জিকা বিক্রি হয়েছিল।
পঞ্জিকার পঞ্চাঙ্গ
পঞ্জিকার মূল পাঁচটি বিষয়কে বলে পঞ্চাঙ্গ। গণক ঠাকুররা পঞ্চাঙ্গের প্রথমটিকে বার বলেন মানে শনি থেকে শুক্র- এই সাত দিনকে বুঝিয়ে থাকেন। তিথি হলো চান্দ্রদিন। চান্দ্রমাসের ৩০ দিন মানে ৩০ তিথি। এক পূর্ণিমা থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী অমাবস্যা পর্যন্ত কৃষ্ণপক্ষীয় তিথি এবং ওই অমাবস্যা থেকে পরবর্তী পূর্ণিমার প্রারম্ভ পর্যন্ত শুক্লপক্ষীয় তিথি। সূর্যের দৈনিক গতিপথ ধরে নক্ষত্র গোনা হয়। এই গতিপথে দেখা মেলে অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আদ্রার মতো মোট ২৭টি নক্ষত্রের। বাংলা মাসের নামকরণে এদের প্রভাব লক্ষণীয়। রাশি বলতে মেষ, মিথুন, বৃশ্চিক ইত্যাদি। ২৭টি নক্ষত্র ১২টি ভাগে ভাগ করে রাশি চিহ্নিত হয়েছে। জীবজন্তুর অবয়বের সঙ্গে মিল রেখে এদের নাম রাখা হয়েছে। পঞ্জিকার চতুর্থ অঙ্গ যোগ। নক্ষত্রের মিলনে যোগের সৃষ্টি হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রে যোগ হলো কালবিশেষ। এর সংখ্যাও ২৭। পঞ্চম অঙ্গ করণ। তিথিগুলোর অংশবিশেষ নিয়ে একেকটি করণ। বব, বালব, কৌলব, তৈতিল ইত্যাদি ১১টি করণ আছে পঞ্জিকা শাস্ত্রে।
এখন অবশ্য মুঠোফোনেও পাওয়া যায় পঞ্জিকার দিনক্ষণ। গুগল প্লে অ্যাপে বাংলা পঞ্জিকার একাধিক অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে। তবে বাঙালির মন তো, নববর্ষের আগেই 'পুরাতন প্রাণের টানেই' ছুট দেয় ওই কম দামি ছাপার হরফে। এ বছর যেন কত সন? উত্তর পেতে ডুব দিতে হয় ফিনফিনে কাগজের মলাটে।