কলকাতা : এ গল্প বানানো নয়। কল্পনা হয়। ঘোর বাস্তব। এক্কেবারে সত্যি। এ ছবিতে একটাই ক্লাইমেক্স নয়। বরং পরতে পরতে উত্তেজনা।  প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বারে বারে ফিরে ফিরে আসে রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত। এখানে দর্শক বারবার দ্বিধায় পড়েন, কাকে সমর্থন করবেন, কাকে ভালবাসবেন। এসআই সুমন্তকে , নাকি ব্যাঙ্ক ডাকাত বিক্রমকে। আসলে শিবপ্রসাদের চরিত্রটিকে ভালবেসে ফেলতে বাধ্য হয়  দর্শক, যে মানুষের ভালো করার জন্য ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে চায়। মানুষের টাকা লুঠ করা অনেক সহজ ঠিকই, কিন্তু বিক্রম ঝুঁকি নিয়ে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে। কারণ সে মনে করে সরকার মানুষের বড় শত্রু। সরকার মানুষের মুখের অন্ন ছিনিয়ে নেয়, কর্মসংস্থান দেয় না, যোগ্য মানুষকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঠেলে দেয়।


 এ ছবিকে ক্রাইম-থ্রিলার বললেও, এই ছবির মূল উপজীব্য হল বহুরূপী-বিক্রমের মূল্যবোধ। সে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আদালতে খুনের অপরাধী প্রমাণিত হয়। আর তার সঙ্গে সবথেকে বড় প্রতারণা করে রক্তের সম্পর্কে থাকা মানুষগুলো, তাও সেই টাকার জন্য। জেলে গিয়ে পুলিশের বেদম প্রহার জোটে কপালে, বারবার নিজেকে নিরপরাধ বোঝাতে চেয়েও ব্যর্থ হয় সে। পুলিশ অফিসার সুমন্তর ( আবীর ) লাঠির বাড়ি খেতে খেতেই তাকে সে জীবন-শত্রু বানিয়ে নেয়। এখান থেকেই আবীর ও শিবপ্রসাদের চরিত্রদ্বয়ের ভাগ্য এক সুতোয় গাঁথা হয়ে যায়।  জেলে গিয়ে ব্যাঙ্ক ডাকাতির দায়ে জেলবন্দি সেলিম খানের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। আর সেই সেলিমই হয়ে ওঠে তার গডফাদার। তার কাছেই ব্যাঙ্ক ডাকাতির ব্যাকরণ শিখে ফেলে সে।


মহাপঞ্চমীতে বক্স অফিসে লড়াইয়ে নেমেছে বাঘা - বাঘা পরিচালকের ছবি । তার মধ্যে এবারের পুজোর অন্যতম চমক নন্দিতা রায়- শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জুটির ছবি বহুরূপী। গত বছর পুজোতে মুক্তি পেয়েছিল তাঁদের 'রক্তবীজ'। আর এবার  শিবু-নন্দিতা জুটির চমক 'বহুরূপী'। 


এ ছবি একাধারে রাজনীতির কথা বলে। শ্রেণিশত্রুদের চেনায়। প্রতিবাদের ভাষা শেখায়। দেখায়, কীভাবে শাসক চক্রব্যূহের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে গরিব মানুষগুলোকে। এ ছবিতে প্রেম আছে, বিশ্বাস আছে, সম্পর্কের মধ্যে আস্থা রাখার শিক্ষা আছে। সে আবীর-ঋতাভরীর রসায়নই হোক না কেন বা কৌশানী - শিবপ্রসাদের জুটির ম্যাজিক,চিরন্তন সম্পর্কের উপর আস্থা ফেরায়।  এ ছবিতে মাটির গন্ধ আছে। রাঢ়বাংলার টান আছে। এখানে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে গিয়ে শিবপ্রসাদ ও কৌশানী একেক সময় একেক রূপে সকলের চোখে ধুলো দিয়েছে। আবার ডাকাতি করে ফেরার সময়ও  তাদের গা-ঢাকা দেওয়ার হাতিয়ার হয়েছে বহুরূপীর পোশাক। এর থেকে বেশি বললে গল্প ফাঁস হয়ে যায়। তবে এ গল্প জেনে গেলেও মানুষ আড়াইটি ঘণ্টা স্ক্রিনে আটকে থাকবে অভিনয়ের মুন্সিয়ানায়, সংলাপে, রুদ্ধশ্বাস চেজিং দৃশ্যে।  এছাড়া ছবি মুক্তির আগে থেকেই মুখে মুখে ফিরছে বহুরূপীর গান। মাটির গন্ধ মেশা এই গান সত্যই গুনগুন করার মতোই। 


'বহুরূপী'র দুই পুরুষও যেমন নিজ নিজ অভিনয় গুণে আর চরিত্রের স্বতন্ত্রতায় মন জয় করবে, তেমনই দুই নারীও নিঃসন্দেহে এখানে অনন্যা। এ ছবির অন্যতম চমক কৌশানী। এখানে তিনি পকেট মারের ভূমিকায়। চমকে দেবে তাঁর শক্তিশালী অভিনয়, সাবলীলতা। অন্যদিকে ঋতাভরীর চরিত্রটির সারল্য, মানসিক টানাপোড়েন, বাইপোলার ডিজঅর্ডারের থাবায় অদ্ভূত অসহায়তা অন্য মাত্রা রেখে যায়। 


ছবিতে বেশ কিছু গাড়ি ধাওয়া করা ও দৌড়ের দৃ্শ্য আছে। শুটিং করতে গিয়ে আহতও হয়েছিলেন শিবপ্রসাদ। চোট সারিয়ে আবার অ্যাকশনে ফিরেছেন। নেচেছেন। অভিনেত্রী কৌশানীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিবপ্রসাদের নাচ মনোগ্রাহী বইকি। এই ছবিতে প্রতিটা চরিত্রই জীবনের কাছে কোথাও না কোথাও গোল খেয়েছে, কিন্তু সেই ধাক্কাকে সামলে ফের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া, হার-না-মানার গল্পটাই এ ছবির মূল উপজীব্য। ছবির শেষ দৃশ্য অবধি দর্শককে সিট থেকে উঠতে দেবে না শিবপ্রসাদ-আবীরের দ্বৈরথ। 


 ছবি শেষের পর আছে চমক। যখন সেই আসল মানুষটিকে পর্দায় দেখা যায়। যিনি আসলেই সাতাশটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছিলেন। যিনি নিজে এসে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আর নন্দিতা রায়কে বলেছিলেন তাঁকে নিয়ে ছবি বানাতে। ১৯৯৮ থেকে ২০০২ পর্যন্ত রাজ্য পুলিশকে কার্যত নাস্তানাবুদ করেছিলেন তিনি। শেখ একলাস ।  তবে সেই সময়ে তেমন গল্প তৈরির মতো পুঁজি ছিল না শিবপ্রসাদ, নন্দিতা রায়দের। আর তাঁদের ঘরানাও ছিল অনেকটা আলাদা। তবে এমন সত্যি অপরাধের কাহিনীর ওপর তৈরি এমন সুন্দর জীবনের গল্প তৈরির জন্য বোধ হয় সময় নিতে হয়।