নয়াদিল্লি: মনমোহন সিংহ নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় UPA সরকারের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে আজও ধরা হয় 2G Spectrum দুর্নীতিকে। অথচ আজ পর্যন্ত ওই মামলায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হননি, বরং একে একে বেকসুর খালাস পেয়ে গিয়েছেন ৩৫ জন। 2G Spectrum দুর্নীতি নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (CBI)-র রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিশেষ CBI আদালতই। সেখানে কোনও দুর্নীতিই ছিল না, শুধু অভিযোগ আনা হয়েছিল বলে মন্তব্য করে CBI আদালত। সেই 2G Spectrum দুর্নীতি মামলার রায় সংশোধনের দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। বিভিন্ন টেলিকম সংস্থাকে দেওয়া লাইসেন্স বাতিল করে স্পেকট্রামে নিলামের নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। সেই নিলামের নির্দেশ সংশোধন করার আর্জি জানাল কেন্দ্র। সরকারি সম্পত্তি নিলাম না করে, কিছু সংস্থার হাতে আলাদা ভাবে স্পেকট্রাম তুলে দিতে চায় তারা। (2G Spectrum Case)


২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আদালত বিভিন্ন টেলিকম সংস্থাকে দেওয়া 2G Spectrum লাইসেন্স বাতিল করে, তার পর ১২ বছরেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। এতদিন পর, সোমবার আদালতের সেই নির্দেশ সংশোধনের আর্জি জানাল কেন্দ্র। কেন্দ্রের তরফে অ্যাটর্নি জেনারেল আর বেঙ্কটরামানি আদালতে বিষয়টি উত্থাপন করেন। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় এবং জেবি পর্দিওয়ালার বেঞ্চের সামনে অন্তর্বর্তী আবেদন খতিয়ে দেখার আর্জি জানান তিনি। অবিলম্বে বিষয়টি নিয়ে শুনানির আবেদন জানান তিনি। অ্যাটর্নি জেনারেল বেঙক্টরামানি জানান, কিছু সংস্থাকে স্পেকট্রামের লাইসেন্স দিতে চায় কেন্দ্র। তাই আগের ওই রায় পুনর্বিবেচনা করে দেখতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে আদালতকে। (2G Spectrum Scam)


২০১২ সালে সমস্ত লাইসেন্স বাতিলের আর্জি জানিয়ে আদালতে আবেদন জানিয়েছিল যে অলাভজনক সংস্থা, তাদের আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণও সোমবার আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় সংশোধনের এই আর্জির বিরোধিতা করেন তিনি। তিনি জানান, আদালতে আগেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে। নিলামের মাধ্যমেই একমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ স্পেকট্রামের লাইসেন্স দেওয়া যেতে পারে এবং নিলামে দাম দিয়ে কিনেই টেলিকম সংস্থাগুলি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করতে পারে বলে স্পষ্ট জানিয়েছিল আদালত। তাই এ নিয়ে পুনর্বিবেচনার কোনও প্রয়োজন আর নেই। বিষয়টি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলাকালীন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় ইমেলে আবেদন চান কেন্দ্রের কাছে।



২০১২ সালে নিলামের পক্ষে রায় দিতে গিয়ে আদালত জানিয়েছিল, স্পেকট্রামের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে কোথাও কোনও বৈষম্য যাতে না হয়, জাতীয় এবং জনস্বার্থ যাতে রক্ষা হয়,  তা দেখার দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই। তাই সর্বসমক্ষে, নিরপেক্ষ ভাবে স্পেকট্রাম নিলাম করতে হবে। দেখতে হবে যোগ্য ব্যক্তির হাতেই যেন স্পেকট্রাম ওঠে। তাই নিলামই একমাত্র উপায়। আদালতের সেই নির্দেশে সংশোধন চেয়ে আবেদন জানিয়েছে মোদি সরকার। নিলামের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত কারণকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে তুলে ধরেছে তারা। প্রশাসনিক পদ্ধতিতে লাইসেন্স প্রদানের সপক্ষে সওয়াল করেছে কেন্দ্র।


২০১৪ সালে মনমোহন সরকারকে উৎখাত করে দিল্লির মসনদে মোদির বসার নেপথ্যে অন্যতম হাতিয়ার ছিল 2G Spectrum দুর্নীতি মামলা। ২০১০ সালে CAG রিপোর্ট তুলে ধরে বলা হয়েছিল, প্রথম UPA সরকারের আমলে 2G লাইসেন্স এবং স্পেকট্রাম দুর্নীতির জেরে প্রায় ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। দ্বিতীয় UPA আমলে বিষয়টি সামনে আসতেই শোরগোল পড়ে যায়। টেলি যোগাযোগ মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন এ রাজা। কালক্রমে তদন্তভার ওঠে CBI-এর হাতে।



অভিযোগ ছিল, কম দামে বাছাই করা কিছু টেলিকম সংস্থাকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, যা ব্যবহার করে মোবাইল ফোনে 2G সাবস্ক্রিপশন বিক্রি করেছিল সংস্থাগুলি। ২০০৮ সালে ২০০১ সালে দরে নতুন করে ১২২টি লাইসেন্স দেওয়া হয় এবং আগে এলে, আগে মিলবে, এই নীতিতেই লাইসেন্স বণ্টন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ২০১১ সালে মনমোহন সরকারের তদানীন্তন টেলি যোগাযোগ মন্ত্রী কপিল সিব্বল জানান, 2G লাইসেন্স বণ্টনে কোনও রাজস্ব ক্ষতি হয়নি সরকারের। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে ওই ১২২টি লাইসেন্স বাতিল করে আদালত। কিন্তু এ রাজা, কানিমোঝি-সহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণই দেখাতে পারেনি CBI. বেকসুর খালাস পেয়ে যান তাঁরা। CBI আদালত জানায়, গুজব, জল্পনার ভিত্তিতে জনমতকে খাড়া করে মামলা সাজিয়েছিল CBI.  সেই সময় মনমোহন সিংহ জানান, ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছিল তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে।


এর পর, যমুনার উপর দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে, চলতি বছরের মার্চ মাসে আবারও 2G মামলা নিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় CBI. এ রাজা এবং অন্য ১৬ জনের মুক্তির বিরুদ্ধে আবেদন জানায় তারা। আদালত তাদের আবেদন গ্রহণও করে। নির্বাচন চলাকালীন এবার আদালতে গেল কেন্দ্রও।


এর আগে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে স্পেকট্রাম বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে কংগ্রেস। তাদের অভিযোগ ছিল, নিয়ম বহির্ভূত ভাবে রিলায়্যান্স, এয়ারটেল, আইডিয়ার মতো সংস্থাগুলিকে স্পেকট্রাম বরাদ্দ করে শর্ত বদল করা হয়েছে। প্রাথমিক টাকা দেওয়ার পর, তিন বছর কোনও টাকা দিতে হবে না। তার পর ১০ বছর সমান কিস্তিতে সরকারকে টাকা দেওয়ার পরিবর্তে, সময়সীমা বাড়িয়ে ১৬ বছর করা হয়েছে। এর ফলে সুদবাবদই প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হবে। নিজের শিল্পপতি বন্ধুদের সুবিধা করে দিতে রাজস্বের ক্ষতি করছে বলে দাবি করেন রাহুল গাঁধী। মোদি সরকার যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে সেই সময়।



কিন্তু পুরনো রায় সংশোধন করতে চেয়ে কেন্দ্রের আদালতে দ্বারস্থ হওয়াকে নেহাত কাকতালীয় ঘটনা বলে দেখছেন না অনেকেই। তাঁদের মতে Bharti Airtel, ইলন মাস্কের Starlink, Amazon, Tata-র মতো সংস্থা নিলাম এড়িয়ে, সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করে স্পেকট্রাম হাতে পাওয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। মুকেশ আম্বানির Jio এবং আদিত্য বিড়লা নিয়ন্ত্রিত Vodafone-Idea সংস্থাও নিলামে না গিয়ে সরকারি দামে স্পেকট্রাম হাতে চায়, যা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থী। সেই কারণেই কেন্দ্র আগের রায়ে সংশোধন চাইছে। বিষয়টি সামনে আসতেই আদালতে গিয়েছেন বিজেপি-র বর্ষীয়ান নেতে সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। 2G Spectrum দুর্নীতি নিয়ে প্রশান্ত ভূষণের সঙ্গে তিনিও আইনি লড়াই লড়েছিলেন সেই সময়। স্বামী কেন্দ্রের আবেদনের প্রতিলিপি চেয়েছেন, তাতে অ্যাটর্নি জেনারেল সম্মতও হয়েছেন বলে খবর।


কিন্তু 2G Spectrum মামলায় আগে থেকেই যেহেতু মূল দুই আবেদনকারী ছিলেন প্রশান্ত এবং স্বামী, তাই এমনিতেই একটি করে প্রতিলিপি তাঁদের প্রাপ্য। সরকার আদালতে যাওয়ার সময়ই তাঁদের ওই প্রতিলিপি দেওয়া হল না কেন, সেই নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। আসলে মোদি সুষ্ঠ নিলাম চান না, কারচুপি করে স্পেকট্রাম বিলিয়ে দিতে চান বলে অভিযোগ করেছেন স্বামীও। 


শিবসেনা নেত্রী প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদীর দাবি, 2G-কে দুর্নীতি বলাই সবচেয়ে বড় দুর্নীতি ছিল। বিজেপি-কে ক্ষমতায় আনাই লক্ষ্য ছিল সেই সময়। পরিকল্পিত ভাবে জনমত তৈরি করে বিজেপি-কে ক্ষমতায় আনা হয়েছিল। এ নিয়ে কেন্দ্রের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি এখনও পর্যন্ত।


আরও পড়ুন: SSC Recruitment:'১৬-র এসএসসি নিয়োগে পুরনো ওএমআর শিট পুনর্মূল্যায়নের কোনও জায়গা নেই, ব্যাখ্যা আইনজীবীদের একাংশের