নয়াদিল্লি: প্রথমে অটল বিহারী বাজপেয়ী, তারপর একে একে মনোহর পর্রিকর, সুষমা স্বরাজ এবং অরুণ জেটলি, দিকশূন্যপুরের দিকে চলে গেলেন বিজেপির মার্গদর্শকরা। গত বছর ১৬ অগস্ট চিরনিদ্রায় গিয়েছেন ভারতরত্ন তথা ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। আর চলতি বছরের অগস্টেই একই পথের পথিক হলেন তাঁরই দুই ভাবশিষ্য। এইমস-এ গিয়ে আর ফেরেননি সুষমা। ফিরলেন না জেটলিও।


চলতি বছরে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যে কারণে গত ফেব্রুয়ারিতে অন্তবর্তী বাজেট পেশ করতে পারেননি তিনি। তাঁর পরিবর্তে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেছিলেন তাঁরই এক সতীর্থ। বিদেশ থেকে ফেরার পর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকায় নিজেই মন্ত্রিত্ব থেকে সরে আসেন। এমনকি সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। একই রকম ভাবে ‘অবসর’-এ চলে গিয়েছিলেন সুষমাও। পরপর দুই নেতার প্রয়াণে স্বাভাবিকভাবেই শোকাহত গেরুয়া শিবির। শোকের ছায়া গোটা রাজনৈতিক মহলেও।


১৯৫২ সালের ২৮ ডিসেম্বর দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন অরুণ জেটলি। বাবা মহারাজ কিষান জেটলি ছিলেন আইনজীবী। তাঁর পড়াশুনার হাতেখড়ি হয় দিল্লির সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করার পর নয়াদিল্লির শ্রীরাম কলেজ অব কমার্স থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন অরুণ জেটলি। এরপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন নিয়ে পড়াশুনা করেন এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।





ছাত্রাবস্থা থেকেই আরএসএস-এর শাখা সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। কলেজ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মেধাবী ছাত্রনেতা জরুরি অবস্থার সময় ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। তৎকালীন ইন্দিরা গাঁধীর সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৯ মাস জেলবন্দিও ছিলেন তিনি। সেখানেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো নেতাদের সঙ্গে। এরপরই সক্রিয় রাজনীতির দিকে ঝোঁক বাড়ে তাঁর। একই সঙ্গে তিনি চালিয়ে যান আইনজীবীর পেশাও।


১৯৮৭ সাল থেকেই দেশের বিভিন্ন হাইকোর্টে মামলা লড়তে শুরু করেন জেটলি। ভিপি সিংহের আমলে তাঁকে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল করা হয়। বোফর্সের মতো হাইপ্রোফাইল মামলায় সরকারি কৌশলীর ভূমিকা পালন করেন তিনি।


১৯৯৯ সালে প্রথমবার এনডিএ সরকার গঠনের পর বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী (স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত) করা হয় তাঁকে। পরের বছরই বাজপেয়ী তাঁর হাতে আইন মন্ত্রকের দায়িত্বও তুলে দেন। পরবর্তীতে তাঁকে দলের সম্পাদকের পদেও আনা হয়। তিনি হয়ে ওঠেন বিজেপির অবিসংবাদিত মুখপাত্র।


২০০৯ সালে প্রথমবার সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন অরুণ জেটলি। অগাধ সাংবিধানিক জ্ঞান, ইতিহাস ও জননীতি নিয়ে পাণ্ডিত্য এবং সুবক্তা হওয়ার সুবাদে রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা হন তিনি। এরপর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পঞ্জাবের কেন্দ্র থেকে  প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। নভজ্যোৎ সিংহ সিধুর পরিবর্তে তাঁকে প্রার্থী করা হয়। তবে সেবার প্রবল মোদি হাওয়ার মধ্যেও কংগ্রেস প্রার্থী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহর কাছে হেরে যান তিনি। কিন্তু এরপরও রাজ্যসভার সদস্য জেটলিকে নিজের মন্ত্রিসভায় সামিল করেন নরেন্দ্র মোদি। অর্থ এবং প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে এমনও বলতে শোনা যায়, মন্ত্রিসভার ‘মূল্যবান হীরে’ অরুণ জেটলি। পরিবেশ মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের কথায় জেটলি একজন ‘সুপার স্ট্র্যাটেজিস্ট’।





উল্লেখ্য, তাঁর হাত ধরেই দেশে চালু হয় গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স। শুধু জিএসটি-ই নয়, ২০১৬ সালের নভেম্বরে নরেন্দ্র মোদি যখন নোটবন্দির (৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল) ঘোষণা করছেন তাঁর নেপথ্যেও ছিলেন বিজেপির এই শীর্ষনেতা। অনেকের মতেই অরুণ জেটলি ছিলেন মোদি মন্ত্রিসভার ‘চাণক্য’।