ঋত্বিক মণ্ডল, কলকাতা: বাগবাজারের কুহেলি বাগ। নিয়মিত বাজার করেন মানিকতলা বাজার থেকে। তাকেই সোমবার দেখা গেল বাজারের পরিচিত মাংস বিক্রেতার সঙ্গে তর্ক জুড়েছেন,  কেন তিনি মুরগীর মাংস কিনতে চাইছেন না। করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে একই অবস্থা শহরের অধিকাংশ মুরগীর মাংসের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের।

আসলে পোলট্রির মুরগীর মাংস থেকে করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে বলে সোশাল সাইটে একটি মেসেজ ভাইরাল হয়। এর থেকেই ক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। গুজবে মুরগীর মাংস কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন অধিকাংশ ক্রেতা। কেউ বা কিনছেন সাত পাঁচ ভেবে। যার জেরে গত পনেরো দিনে প্রায় তিরিশ থেকে  চল্লিশ শতাংশ বিক্রি কমে গিয়েছে মুরগীর মাংসের। কোনও কোনও বাজারে বিক্রি কমেছে পঞ্চাশ শতাংশ!

ব্যবসায়ীরা বলছেন এই ভুয়ো  আতঙ্কের জেরেই হু হু করে কমছে মুরগীর মাংসের দাম। মানিকতলা বাজারের মুরগী বিক্রেতা রহিম জোয়ারদার বলছিলেন, "লক্ষ্য করছি খদ্দেরদের মধ্যে একটা আতঙ্ক রয়েছে। তার জন্যই মাংসের দাম তিরিশ  থেকে চল্লিশ  টাকা কমিয়েছি। আমার যিনি বাঁধা খদ্দের, তিনিও মাংস কিনতে এসে দ্বিধা করছেন। আমরা সকলকে বোঝাচ্ছি যে বিষয়টা গুজব।"



সোমবার সকাল থেকে শহরের বাজারগুলোতে ঘুরে দেখা গেল মুরগীর মাংসের দামে বেশ হেরফের হয়েছে। ১৫ দিন আগে মানিকতলা বাজারে গোটা মুরগীর দর ছিল ১২০ টাকা। সোমবার তা বিক্রি  হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি দরে। কাটা মুরগীর মাংসের দাম ছিল ১৬০ টাকা প্রতি কেজি। এই সপ্তাহে দাম নেমেছে ১৩০ টাকায়।  দিন পনেরো আগে লেক মার্কেটে গোটা মুরগীর দাম ছিল ১০০ টাকা প্রতি কেজি। এখন তার দাম হয়েছে কেজি প্রতি ৮০ টাকা। সেখানেই কাটা মুরগী বিক্রি হচ্ছিল কেজি প্রতি ১৮০ টাকায় । এখন সেই দাম হয়েছে ১৬০ টাকা। একই ছবি গড়িয়াহাট বাজারে। গোটা মুরগীর দাম ১২০ টাকা থেকে নেমে হয়েছে কেজি প্রতি ১০০ টাকা । ১৭০ টাকায় বিক্রি হওয়া কাটা মুরগীর মাংসের দাম কমেছে কেজিতে ২০ টাকা।

জেলার প্রত্যেকটি বাজারেও আতঙ্কের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।  ইতিমধ্যেই ক্ষতির অঙ্ক ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে দাবি করছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। পশ্চিমবঙ্গ পোল্ট্রি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মদন মোহন  মাইতি বলেছেন, "শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া গুজবের জেরে কলকাতা-সহ জেলার প্রত্যেকটা বাজারে মুরগীর মাংসের বিক্রি প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। বিক্রি নেই বলে শহরের বাজারগুলোতে ১০০ টাকা কেজি দরেও ব্যবসায়ীদের মাংস বিক্রি করতে হচ্ছে।  এইভাবে চলতে থাকলে চলতি সপ্তাহের শেষে ক্ষতির অঙ্ক আরও ১৬০ কোটি টাকা বাড়বে বলে আমাদের আশঙ্কা।‘’   তিনি এও জানিয়েছেন যে, করোনা আতঙ্কে ডিমের বিক্রিতেও ঘাটতি হয়েছে। প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে বিক্রি।

যদিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এই আতঙ্কের খবরের কোন বাস্তব ভিত্তি নেই বলেই জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলছেন, "কীভাবে মুরগীর মাংস থেকে করোনা ভাইরাস ছড়াবে? এটা সাধারণত বায়ুবাহিত রোগ। এটা মুরগীর মাংস খেলে ছড়াতে পারে না।  কিছু রোগ আছে যেগুলো খাদ্যবাহিত আর কিছু আছে বায়ুবাহিত। নোবেল করোনাভাইরাস কোনওভাবেই খাদ্যবাহিত রোগের তালিকায় পড়ে না।" তিনি যোগ করেছেন, "এভাবে গুজব ছড়ালে শুধু নিজেদেরই ক্ষতি হয় না। ব্যবসারও ক্ষতি হয়।"

চিনের গবেষকরা জানিয়েছিলেন, বাদুড়ের শরীর থেকে সাপ, বনবিড়াল বা অন্য কোনও প্রাণীর শরীরে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। এই প্রেক্ষিতেই মুরগির মাংস নিয়ে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের ভেটেরনারি অ্যাসোসিয়েশন জনস্বার্থে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। যাতে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে, পোলট্রিজাত দ্রব্য থেকে নোবেল করোনাভাইরাস কোনওভাবেই মানুষের শরীরে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিশ্বজুড়ে ২০০২ এবং ২০১২ সালে যে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের ঘটনাগুলো সামনে এসেছিল তাতে মুরগীর মাংস থেকে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার কোনও নজির নেই।

একই নির্দেশিকা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-ও।