চন্দননগর: করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয় সৈনিক ছিলেন তিনি। তবে মারণভাইরাস প্রাণ কেড়েছে তাঁর। তিনি, হুগলির চন্দননগরের মহকুমাশাসকের দফতরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে করোনার কাছে হার মেনেছেন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যিনি করোনার মোকাবিলা করেছিলেন, বিপদের তোয়াক্কা না করে কর্তব্যে অবিচল ছিলেন, সেই দেবদত্তা ব্যক্তি হিসাবে কেমন ছিলেন?


‘মৃদুভাষী ছিল। আর ভীষণ শান্ত। ওর এই শান্ত স্বভাবের জন্যই অনেক কঠিন পরিস্থিতি সামলে দিতে পারত,’ মোবাইল ফোনে এবিপি আনন্দকে বললেন মৌমিতা সাহা। চন্দনগরের মহকুমাশাসক মৌমিতার অধীনেই কর্মরত ছিলেন দেবদত্তা। সহকর্মীর মৃত্যুতে মর্মাহত তিনি। মৌমিতা বললেন, ‘কাজের বাইরেও ওর সঙ্গে আমার হৃদ্যতা ছিল। বই পড়তে ভীষণ ভালবাসত। সময় পেলেই বই পড়ত। বই নিয়ে গল্প করত। কর্মব্যস্ততার মধ্যেও ছেলেকে অনেক সময় দিত। ভীষণ স্নেহশীল ছিল।’

দেবদত্তা আগে পুরুলিয়ার বিডিও ছিলেন। বদলি হয়ে আসেন চন্দননগরে। দমদম নাগেরবাজারের বাড়িতে থাকতেন স্বামী পবিত্র, শাশুড়ি ও ৪ বছরের শিশুপুত্র। যাঁরা প্রত্যেকেই করোনা আক্রান্ত। সকলেই ভর্তি বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। মৌমিতা জানালেন, ওঁদের চিকিৎসা চলছে। সকলেই সুস্থ আছেন।

করোনা-যোদ্ধা হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন দেবদত্তা। সহকর্মীরা সকলেই পছন্দ করতেন। অফিসের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন দেবদত্তা। মৌমিতা বলছেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। চন্দননগরের উর্দি বাজারে সংক্রমণ ভয়াবহ চেহারা নিয়েছিল। সেই যুদ্ধে সামনের সারিতে ছিল। ডানকুনিতে গিয়েছে। ফিল্ডে নেমে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করেছে। কঠিন পরিস্থিতিতে প্রত্যেক পরীক্ষার মুখে আমার সঙ্গী ছিল। ভীষণ সক্রিয় ছিল দেবদত্তা। সকলের সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারত। তাই কাজের ভীষণ সুবিধা হতো।’

পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর কাজটা কতটা কঠিন ছিল দেবদত্তা ও আপনাদের গোটা দলের কাছে? শ্রমিকদের কেউ সংক্রমিত হওয়া মানে তো আপনাদেরও প্রাণের ঝুঁকি? মৌমিতা বলছেন, ‘শ্রমিকদের মধ্যে কেউ আক্রান্ত কি না, আমাদের পক্ষে তা জানা সম্ভব ছিল না। আমরা সেসব নিয়ে ভাবিওনি। ডানকুনি থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে দেবদত্তা। ওর কর্তব্যপালন করে গিয়েছে নিষ্ঠার সঙ্গে।’

কিন্তু শ্রমিকদের বাড়ি ফেরাতে পারলেই তো কাজ শেষ নয়! ফেরার পর প্রতিবেশীদের বাধার মুখে বাড়ি ঢুকতে পারছেন না, এরকম খবর প্রায়শই সামনে আসছে। করোনাকে হারিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পর বাড়ি ফিরতেও সমস্যা পড়ছেন অনেকে। দেবদত্তা ও আপনারা সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন? মৌমিতা বলছেন, ‘যাঁদের ফেরাচ্ছি, তাঁরা যাতে জনরোষের শিকার না হন, সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছি আমরা। প্রয়োজনে মানুষকে বোঝাচ্ছি। চন্দননগর মহকুমায় এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। কয়েকদিন আগেই ভদ্রেশ্বরের এক ভদ্রলোক ফোন করে জানালেন, সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও ওঁকে কাজে যোগ দিতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা মালিকপক্ষকে বুঝিয়েছি। লাভও হয়েছে। উনি কাজে যোগ দিয়েছেন। মানুষকে বোঝানোটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। উর্দি বাজারেও করোনা-জয়ীদের দোকান খুলতে দেওয়া হচ্ছিল না। ওখানে অনেকে আছেন যাঁরা শ্রমিক বা বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করেন। আমরা তাঁদের পাশেও দাঁড়িয়েছি।’

মৌমিতা জানালেন, তাঁর ও প্রয়াত সহকর্মী দেবদত্তার লক্ষ্যই ছিল, আক্রান্ত কেউ চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এরকম অভিযোগ যেন না ওঠে। বললেন, ‘যখনই এরকম কোনও খবর পেয়েছি, পদক্ষেপ করেছি। করোনায় মৃত্যুকে আটকে রাখা আমাদের হাতে নেই। তবে কেউ মারা গেলে তাঁর মৃতদেহ ফেলে রাখা হচ্ছে, এরকম ঘটনা চন্দননগর মহকুমার অধীনস্থ অঞ্চলে ঘটেনি। মৃতদেহকে নিয়ে টানাপোড়েন হতে দিইনি। কেউ বিনা চিকিৎসায় পড়ে রয়েছেন, এরকমও অভিযোগ নেই। সকল আক্রান্তের জন্য হাসপাতালে বেডের ব্যবস্থা করতে তৎপর ছিলাম আমরা।’

দেবদত্তা ১ জুলাই থেকে ছুটিতে ছিলেন। তাই তাঁর দফতরের কাউকে নিভৃতবাসে যেতে হয়নি। মৌমিতা নিজে বিরাটির বাসিন্দা। তবে পরিবার ছেড়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে চন্দননগরেই থাকছেন। চন্দননগরের মহকুমাশাসক বলছেন, ‘খুব কঠিন পরিস্থিতি। সামলানোর চেষ্টা করছি। আতঙ্ক ও উদ্বেগ কাটিয়ে লোকজনকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে চাইছি। চাইছি সকলে স্বাভাবিকভাবে কাজে ফিরুক। কেউ আতঙ্কিত হবেন না। প্রশাসন সকলের পাশে রয়েছে। কেউ করোনা আক্রান্ত মানেই তিনি সমাজে ব্রাত্য বা কলঙ্কিত নন।’ দেবদত্তা কাজ ভালবাসতেন। মৌমিতা বলছেন, ‘আমাদের কাজের মধ্যেই ও বেঁচে থাকবে।’