সৌভিক মজুমদার, কলকাতা: বাংলার করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খোলা চিঠি দেওয়ায়, তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রর সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন ১৪ জন প্রবাসী বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক। এবার তাঁদের সমর্থনে বিবৃতি জারি করলেন বাংলার চিকিৎ‍সক-বিজ্ঞানী-শিল্পী-শিক্ষাবিদদের একাংশ। বিবৃতিতে সই করেছেন, পরিচালক তরুণ মজুমদার, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী, প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন থেকে একাধিক বিজ্ঞানী, চিকিৎ‍সক।


বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রবাসী চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। সাবধান করেছিলেন, রাজ্য যদি করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক তথ্য না প্রকাশ করে, তাহলে তা রাজ্যের জন্য বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে!’

গোটা বিতর্কের সূত্রপাত বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাঙালি চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীর একটি খোলা চিঠিকে কেন্দ্র করে। পত্রলেখকরা ইংল্যান্ড, আমেরিকার মতো বিভিন্ন দেশে গবেষণা বা চিকিৎসার কাজে নিযুক্ত। তাঁরা খোলা চিঠিতে অভিযোগ তুলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক পরিসংখ্যান জানোনা হচ্ছে না। পর্যাপ্ত করোনা পরীক্ষাও হচ্ছে না।’

এই চিঠির কড়া সমালোচনা করে কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র গত ২৪ এপ্রিল ট্যুইট করেন, ‘১৪ জন প্রবাসী চিকিৎসকের মধ্যে ১১ জন আমেরিকা, দু’জন ব্রিটেন এবং একজন জার্মানির। যথাযোগ্য সম্মান রেখে বলছি, আপনারা তো অন্য দেশে থেকে চিকিত্‍সা করছেন, কর দিচ্ছেন। ভারতের তুলনায় আমেরিকা ও ব্রিটেনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি। আপনারা বরং যে দেশকে বসবাসের জন্য যে বেছে নিয়েছেন, সেখানেই কাজ করুন।’

এর পাল্টা বিবৃতিতে বাংলার বিদ্বজ্জনদের তরফে সাংসদ মহুয়া মৈত্রর নাম না করে লেখা হয়েছে, ‘এক সাংসদের এহেন ক্ষোভপ্রকাশ অপরিণত, অবৈজ্ঞানিক এবং প্রতিশোধমূলক!’ পরিচালক অনীক দত্ত বলেছেন, ‘মহুয়া মৈত্রর বক্তব্য সঠিক নয়, প্রবাসীরা চিন্তিত তাই বলেছেন।’

প্রবাসীদের বিঁধে, মহুয়া মৈত্র অন্য একটি ট্যুইটে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আপনারা থাকার জন্য যে দেশকে বেছে নিয়েছেন, সেই আমেরিকা বা ব্রিটেনের করোনা-পরিসংখ্যান খুবই খারাপ। উন্নত অর্থনীতি হওয়া সত্বেও পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তা নিয়ে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সচিব, ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা স্টেট গভর্নরদের কেন চিঠি লিখছেন না?’

পাল্টা বিবৃতিতে বাংলার বিদ্বজ্জনদের প্রশ্ন, ‘বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা কি কারও থাকার জায়গা বা নাগরিকত্বের বিচারে আবদ্ধ করা যায়? রাজ্য সরকার কোভিড-১৯ এর মোকাবিলায় যে ওয়ার্ল্ড অ্যাডভাইজরি কমিটি গড়েছে, তাতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও বাকিদের অধিকাংশই প্রবাসী। তা হলে এই দ্বিচারিতা কেন?’

শিল্পী সমীর আইচ বলেছেন, ‘আমরা সমর্থন করছি ডাক্তারদের, তাঁরা তো ভুল কিছু বলেননি।’

বিদ্বজ্জনদের বিবৃতিতে এও লেখা হয়েছে, ‘এই সাংসদই, সংসদে বলেছিলেন, সরকারের সমালোচনা করা মানেই দেশের বিরোধিতা করা নয় এবং বাক্ স্বাধীনতার অধিকার হরণ করা ফ্যাসিস্ট মনোভাবের লক্ষণ। তা হলে কেন রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমালোচনাকে রাজ্যবিরোধী বলা হবে? তা ছাড়া ওই চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা দেশে বসবাস করেন না বলে তাঁরা রাজ্যের কি সমালোচনাও করতে পারবেন না?’

পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘কেউ বাইরে আছে বলে, প্রবাসে আছে বলে বলবেন না তেমন নয়।’

বিদ্বজ্জনদের বক্তব্য, ‘মহামারির সময়ে একজন সাংসদের এরকম আচরণে আমরা, পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা অস্বস্তিতে পড়েছি। এটা অনভিপ্রেত। প্রকৃত ঘটনা থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা এবং মহামারি নিয়ে অহেতুক রাজনীতি করা ছাড়া কিছুই নয়। এই সঙ্কটের সময় দোষারোপ-অভিযোগের ঊর্ধ্বে উঠে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’

এই প্রেক্ষিতে পাল্টা সমালোচনার সুর উঠে এসেছে শাসক শিবির থেকে। রাজ্যসভার সাংসদ শান্তনু সেন বলেছেন, ‘তাঁরা যেখানে বসে বলছেন উদ্বিগ্ন, সে তো ভাল কথা, কিন্তু, তাঁরা যেখানে বসে আছেন, সেখানকার পরিস্থিতি আর এখানকার পরিস্থিতি তো এক নয়। এখানে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ, আর ওখানে যা বরাদ্দ সেটা এক নয়। যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যেই আমরা চেষ্টা করছি।’