নয়াদিল্লি: তিন সপ্তাহের যুদ্ধে গাজায় প্রাণ গিয়েছে ৭ হাজার ৭০৩ জনের। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যাই ৩ হাজার ৫০০। আহত প্রায় ২০ হাজার মানুষ। নিরন্তর সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে চলেছে বলেও ভূরি ভূরি অভিযোগ জমা পড়ছে। কিন্তু শুধুমাত্র গাজায় নয়, ইজরায়েল অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও (West Bank) প্যালিস্তিনীয়রা গত তিন সপ্তাহ ধরে কচুকাটা হচ্ছেন বলে অভিযোগ আসতে শুরু করল। গত তিন সপ্তাহে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে যত সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছেন, বিগত ১৫ বছরের হিসেব ছাপিয়ে গিয়েছে বলে খবর। (Israel Palestine War)
গত ২৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপুঞ্জে হতাহতের বিশদ রিপোর্ট জমা দেয় প্যালেস্তাইনের স্বাস্থ্য বিভাগ। তাতে বলা হয়, ৭ অক্টোবর নতুন করে যুদ্ধ বাধার পর থেকে ১৫ দিনে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ৯৫ জন প্যালেস্তিনীয়ের মৃত্যু হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হিংসা, হামলার ঘটনা। তাতে এক ইজরায়েলি সৈনিকও মারা যান। আর শনিবার, ২৮ অক্টোবরের রিপোর্ট বলছে, গত তিন সপ্তাহে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে ১১১ জনের মৃত্যুর খবর সামনে এসেছে। আহতের সংখ্যা ১৯৫০। বিবৃতি প্রকাশ করে এই তথ্য জানিয়েছে প্যালেস্তাইনের স্বাস্থ্যমন্ত্রক। (Israel Palestine Conflict)
ইজরায়েলি সেনার সঙ্গে সংঘর্ষেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে অধিকাংশ প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানানো হয়েছে। বাকি যে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা সামনে এসেছে, তা সেখানে বসবাসকারী ইজরায়েলি নাগরিক এবং প্যালেস্তিনীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে। প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, ১১ অক্টোবর কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা একটি দল কুসরা গ্রামে তিন জন প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করে। পর দিন ওই তিন জনের শবযাত্রার সময় ফের হামলা হয়, তাতে আরও দু’জন মারা যান।
হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালীনই সম্প্রতি ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের জেনিন মসজিদে রাতের অন্ধকারে ইজরায়েল হামলা চালায়, যাতে দু’জন প্যালেস্তিনীয় মারা যান। ইজরায়েলি সেনার দাবি, মসজিদের নীচের অংশ সন্ত্রাসবাদীরা ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। সেখান থেকে সংগঠত আক্রমণ হানার পরিকল্পনা চলছিল। তাই মসজিদে হামলা চালানো হয়।
এর পর, নুর শামস শরণার্থী শিবিরেও হামলা চালায় ইজরায়েলি সেনা, তাতে ১৩ জন প্যালেস্তিনীয় মারা যান, যার মধ্যে পাঁচ শিশুও ছিল। মারা যান এক ইজরায়েলি সৈনিকও। পর পর এই ধরনের ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিভাগের প্রধান রবীনা শামদাসানি। তিনি বলেন, “অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে যেভাবে মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে, পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে লাগাতার, বেআইনি ভাবে প্রাণঘাতী শক্তির ব্যবহার হচ্ছে,তাতে উদ্বিগ্ন আমরা।”
৭ অক্টোবর নতুন করে যুদ্ধ বাধার আগেও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে মৃত্যুমিছিল চলছিল, বিশেষ করে শিশুমৃত্যু অব্যাহত ছিল বলে দাবি করেছে ডিফেন্স অফ চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল নামের প্যালেস্তাইনের মানবাধিকার সংগঠন (DCI-P)। তাদের দাবি, চলতি বছরই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে সর্বাধিক প্যালেস্তিনীয় শিশু মারা গিয়েছে।
DCI-P জানিয়েছে, গত বছর থেকে ইজরায়েলি সেনার হানা বেড়েছে। যখন তখন শহর, গ্রাম, শরণার্থী শিবিরে হানা দেয় তারা। কখনও শিশুদের হত্যা করে, কখনও পঙ্গু করে দেয়, কখনও আবার গ্রেফতারও করে। সম্প্রতি ৮ থেকে ১৩ বছর বয়সি নয় প্যালেস্তিনীয় শিশুকে ইজরায়েলি সেনা গ্রেফতার করেছে বলে জানায় DCI-P. এর মধ্যে রবার বুলেটে ১৩ বছর বয়সি এক কিশোর আহতও হয় বলে জানিয়েছে তারা। প্রায় চার ঘম্টা পর তাদের মধ্য থেকে সাত জন এবং পরে আরও দু’জনকে ছাড়া হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও-ও সামনে এসেছে, যাতে কংক্রিটের উপর বসানো কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে বন্দি থাকা প্যালেস্তিনীয় শিশুদের দেখা গিয়েছে। কাঁটাতারের এপার থেকে তাদের ছেড়ে দেওয়ার আর্জি জানাতে দেখা গিয়েছে মায়েদের। ওই ভিডিও-র সত্যতা যাচাই করেনি এবিপি আনন্দ।
এবছর সেপ্টেম্বরে জেরিকোর আকবাত জাবর এলাকায় তল্লাশি চালানোর সময় ১২ এবং ১৪ বছর বয়সি দুই স্কুল পড়ুয়া ইজরায়েসলি সেনার হাতে আহত হয় বলে জানা যায়। জুলাই মাসে জেনিনের শরণার্থী শিবিরে ৪৮ ঘণ্টায় ইজরায়েলি সেনার হাতে ১০ প্যালেস্তিনীয়ে মৃত্যু হয়, যার মধ্যে অনূর্ধ্ব ১৮ পাঁচ কিশোর ছিল। অগাস্ট মাসে একটি মানবাধিকার সংগঠন জানায়, ২০২২ সালে ইজরায়েসলি সেনার হাতে ৪৫ শিশুর মৃত্যু হয়। এবছর জুলাই মাস পর্যন্ত তা ৪৭ হয়ে গিয়েছে। DCI-P জানিয়েছে, বর্তমানে ইজরায়েলি সেনার হাতে বন্দি রয়েছে ১৬০ প্যালেস্তিনীয় শিশু বন্দি রয়েছে, যার মধ্যে ৩২ জনের বয়স ১৫ বছরের নীচে। ২০০০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ইজরায়েলি সেনার হাতে ২ হাজার ২৮৭ প্যালেস্তিনীয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এরই মধ্যে প্যালেস্তাইনের প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ স্তাইয়ে চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন। তাঁর দাবি, গাজাকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহুর। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে তিনি ইজরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। তার জন্য ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে প্যালেস্তিনীয় মুক্ত করতে হত্যালীলায় অনুমোদন দিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতে প্যালেস্তাইনের কোনও অস্তিত্বই না থাকে।