ঢাকা: পাঠ্যবই থেকে দেশের মুদ্রা, সবেতেই পরিবর্তনের হাওয়া। বাংলাদেশে এবার বদলে যাচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামীর সংজ্ঞাও। মহম্মদ ইউনূসের অন্তবর্তীকালীন সরকার নয়া অধ্য়াদেশ জারি করেছে, যাতে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামীর সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে। নতুন সংজ্ঞা মানলে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে দেশের ৪০০ অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী আর স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে গণ্য হবেন কিনা উঠছে প্রশ্ন। (Bangladesh Freedom Fighter Ordinance)

Continues below advertisement

বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনে সংশোধন ঘটাতেই মঙ্গলবার রাতে নতুন অধ্যাদেশটি জারি করা হয়, যদিও অনুমোদন মিলেছিল আগেই। সেই অনুযায়ী, দেশের জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, অর্থাৎ মুজিবনগর সরকারে যুক্ত ছিলেন এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে  গণপরিষদের সদস্য বিবেচিত হন, তাঁরা এখন থেকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’র পরিবর্তে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী’ হিসেবে গণ্য হবেন। (Bangladesh News)

মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে মুজিব সরকার। বলা হয়েছে--- 

Continues below advertisement

  • মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মসূত্রে যাঁরা বিদেশে ছিলেন এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে নিজ নিজ অবদান রেখে যান, তাঁরাও  ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী’ হিসেবে গণ্য হবেন। 
  • যে সমস্ত বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে জনমত গড়ে তোলেন, মুজিবনগর সরকাররে প্রতিনিধি বা আধিকারিক হিসেবে কাজ করেন, চিকিৎসক, নার্স এবং মুজিবনগর সরকারের অন্য কর্মীরাও ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী’।
  • স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সমস্ত শিল্পী এবং কর্মী, সেই সময়কার সাংবাদিক, যাঁরা দেশের বাইরে থেকেও মুক্তিযুদ্ধে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন, সক্রিয় সমর্থন জোগান, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলও ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী’। 
  • ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে কারা বিবেচিত হবেন, তার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের অন্দরে যুদ্ধির প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণে অংশ নেন, বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে সীমান্ত পেরোন, ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে নাম নথিভুক্ত করেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন— হানাদার তথা দখলদার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকার,আলবদর, আলশামস, তদানীন্তন মুসলিম লিগ, জামায়াতে ইসলামি, নেজামে ইসলাম, দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশ নেন, সমস্ত নিরীহ নাগরিক যাঁদের বয়স সরকারি নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল, তাঁরা ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে গণ্য হবেন। পাশাপাশি, সশস্ত্র বাহিনী, পূর্ব পাকিস্তান রাউফেলস, পুলিশ বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, মুজিবনগর সরকার ও সেই সরকার স্বীকৃত নৌবাহিনী, অন্যান্য বাহিনী, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্যরাও এখন থেকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’।
  • হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানী বাহিনিএবং তাদের সহযোগীরা যে সমস্ত নারীর উপর অত্যাচার চালায়, সেই বীরাঙ্গনারাও ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে গণ্য হবেন এখন থেকে। মুক্তিযুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা ও শুশ্রূষা করেন যাঁরা, সেই সব চিকিৎসক, নার্স ও সহকারীরাও একই সম্মান পাবেন।
  • জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ লেখাটি যদিও বাদ দেওয়া হয়েছে। যেখানে যেখানে ওই নাম লেখা ছিল, ছেঁটে ফেলা হয়েছে ধরে ধরে।
  • মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা হিসেবে লেখা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য়ে, হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী, তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল শামস, মুসলিম লিগ, নেজামে ইসলাম, দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধই মুক্তিযুদ্ধ।

এই অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু মুজিব, দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দিন আহমেদ এবং আরও ৪০০ জনের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সম্মান থাকবে কি না, তা নিয়ে ধন্দ দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী সেই নিয়ে মুখ খোলেন সংবাদমাধ্যমে। বলেন, “১৯৭২ সাল থেকে এটাই দেখছি। প্রত্যেক বার নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নতুন তালিকা তৈরি করে। এতে ব্যক্তিগত স্বার্থও লুকিয়ে থাকে। মানুষ এসব গ্রহণ করবে না। সাধারণ মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধ যা ছিল, তেমনই থাকবে।”

বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হতেই বুধবার সাফাই দেয় ইউনূস সরকার। বঙ্গবন্ধু মুজিবের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সম্মান বাতিল করা হয়নি বলে জানানো হয়। ইউনূসের ডেপুটি প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার বলেন, “আইন সংশোধন করা হলেও, শেখ মুজিবের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল করা হয়নি।” দেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রকের উপদেষ্টা ফারুখ-ই-আজম জানান, মুজিবনগর সরকারে যাঁরা শামিল ছিলেন, তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধা। যাঁরা নেতৃত্ব দেন, যাঁরা লড়াই করেন যুদ্ধে, তাঁরা সকলেই স্বাধীনতা সংগ্রামী। সেই সরকারের আধিকারিক, কর্মীরা  মুক্তিযোদ্ধাদের সহকারী।