নয়াদিল্লি: বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই অশনি সঙ্কেত দেখতে পেয়েছিলেন অনেকে। যেভাবে বাংলাদেশের সংরক্ষণবিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানায় পাকিস্তান, মহম্মদ ইউনূস সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাতে ১৯৭১-এর ইতিহাস ভুলে দুই দেশ আবারও পরস্পরের কাছাকাছি আসতে পারে বলে প্রমাদ গুনছিলেন অনেকেই। সেই আশঙ্কা সত্যি করে গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানে জাহাজেক নোঙর করতে দেখা যায়। এবার ঢাকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আহমেদ মারুখ জানালেন, সমুদ্রপথে এই যোগাযোগ স্থাপনে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতিসাধন হবে। (Bangladesh-Pakistan Sea Link)


গত রবিবার বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে পাকিস্তান থেকে যাওয়া একটি পণ্যবাহী জাহাজ। গত পাঁচ দশকে এই প্রথম, সমুদ্রপথে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হল। পানামার পতাকা লাগানো, Yuan Xiang Fa Zhan নামের ১৮২ মিটার দীর্ঘ ওই জাহাজটিতে কন্টেনার বোঝাই করা ছিল। করাচি থেকে চট্টগ্রাম  নামিয়ে আবার রওনা দেয় জাহাজটি। চট্টগ্রাম বন্দ কর্তৃপক্ষ জানান, পাকিস্তান এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে কাঁচামাল পৌঁছে দেওয়া হয় জাহাজে চাপিয়ে। খাদ্যপণ্য ছাড়াও বস্ত্রশিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পৌঁছে দেওয়া হয় বাংলাদেশে। (Bangladesh-Pakistan Relations)


পাকিস্তান থেকে আগে বাংলাদেশে জিনিসপত্র সরবরাহ হয়নি এমন নয়। কিন্তু এতদিন তা হতো ঘুরপথে। প্রথমে শ্রীলঙ্কা, তার পর মালয়েশিয়া অথবা সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশ পৌঁছত জিনিসপত্র। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি করার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ শিথিল করেছে। আগে পাকিস্তান থেকে আসা জিনিসপত্রের তল্লাশি নেওয়া হতো, ফলে গোটা প্রক্রিয়া মিটতেও দেরি হতো। নয়া নিয়মে সেসবের বালাই নেই।


সমুদ্রপথে সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে নোবেলজয়ী ইউনূস পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়া আরও মজবুত করতে চাইছেন বলে মত কূটনীতিকদের। আর সেই জল্পনায় কার্যত সিলমোহর দিয়েছেন ঢাকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মারুফ। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতিতে এই সরাসরি বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছে বলে মত তাঁর।  এতে দুই দেশেই উপকৃত হবে, বাণিজ্যক্ষেত্রে সুবিধা ভোগ করবে বলে মত তাঁর। 


১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনার হাতে ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, দমন-পীড়ন, ধর্ষণ, অত্যাচারের ক্ষত এত বছর ধরে দগদগে ছিল। হাসিনার রাজনৈতিক মন্ত্রই ছিল পাকিস্তান বিরোধিতা। এমনকি মুক্তি যুদ্ধে যে হত্যালীলা চালায় পাকিস্তান, তার জন্য ২০১০ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালেরও সূচনা করেন তিনি, যাতে যুদ্ধাপরাধী 'রাজাকার'দের বিচার হয়। এমনকি পাকিস্তানপন্থী জামাত-ই-ইসলামি সংস্থাটিকেও নিষিদ্ধ করেন হাসিনা। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন সংস্থার নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা। হাসিনার আমলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রথম 'রাজাকার' হিসেবে গন্য হন কাদের।


হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাশে থাকার জন্য, একাধিক বার ভারতের অবদানও স্বীকার করেন হাসিনা। নেহরু-গাঁধী পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর। এমনকি সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনে যখন উত্তাল দেশ, সেই সময় ভারতেই নিরাপদ আশ্রয় পান হাসিনা। আর হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়ার পর থেকেই পাকিস্তানকে নিয়ে সুর নরম করতে শুরু করে ঢাকা। একরকম ভাবে ভারত বিরোধিতাও শুরু হয়। তাঁদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত বড্ড মাথা ঘামায় বলে মনে করতে শুরু করেন বাংলাদেশি নাগরিকরা। আর এই ভারত বিরোধিতা যত বাড়তে থাকে, ততই বাড়তে থাকে পাকিস্তানপ্রীতি। দেশের মানুষের নাড়ি বুঝেই জামাতের উপর থেকে নিষিধাজ্ঞা তুলে নেয় ইউনূস সরকার। এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারে আলোচনাও হয় তাঁর। পাকিস্তানের সঙ্গে সমুদ্রপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন নিয়ে ইউনূসকে বলতে শোনা যায়, "সম্পর্ক আগের জায়গায় নিয়ে যেতে এই সমুদ্র সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"


বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের এই সখ্যকে ভারতের উপর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। নিয়মিত জলপথে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য শুরু হলে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেবে। পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা ISI বাংলাদেশে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। হাসিনার আমলে এমন দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না।  ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছ থেকে ১৫০০ বাক্স চিনা অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়। ISI-এর পাঠানো ওই অস্ত্রশস্ত্র অসমের জঙ্গি সংগঠন United Liberation Front of Asom (ULFA)-র কাছে যাচ্ছিল। তাই বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব কমলে ভারতের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।