পল্লবী দে,  কলকাতা: রাখির সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস জড়িয়ে অনেক আঙ্গিকে। সেখানে ধর্ম যেমন রয়েছে, আছে ইতিহাসের ছোঁয়া, আছে আবেগ। পুরাণ প্রসঙ্গও সেই কাহিনী বলে। মহাভারতের শিশুপাল বধ হত্যায় শ্রীকৃষ্ণের রক্তাক্ত হাতে ওড়না বেঁধে দিয়েছিলেন দ্রৌপদী। ভাইকে রক্ষায় বোনের সেই বাঁধন দেশজুড়ে পালিত হয় রাখি বন্ধন উদযাপনে। আবার বঙ্গভঙ্গ আইনে যখন ভাগ হচ্ছে দুই বাংলা, সেই অশান্ত মূহুর্তকে সম্প্রীতির বন্ধনে বেঁধেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আশ্বিনের সেই শুভক্ষণ তৎকালীন সময়ে স্থানও পেয়েছিল পঞ্জিকাতে। শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার সঙ্গে অবশ্য এ রাখি বন্ধনের যোগ প্রায় নেই। যা আছে তা ভ্রাতৃত্বের এবং সম্প্রীতির।



রাখি 'পূর্ণিমার' সঙ্গে যোগ না থাকলেও রাখি বন্ধন বলতেই উঠে আসে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ। ফিরে আসে বঙ্গভঙ্গের সেই অস্থির সময়। লর্ড কার্জন তখন ভাইসরয়। ইংরেজরা দেশ ছাড়ার আগে বাংলা ভাগ করে যাবে, এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানান হতেই দেশজুড়ে উঠল বিরোধিতার রব। বাংলা তখন জ্বলছে। রবীন্দ্রনাথের কলমে একের পর গর্জে উঠছে একের পর এক স্বদেশী কবিতা-গান। লিখলেন- "ধর্ম আমার মাথায় রেখে/ চলব সিধে রাস্তা দেখে/ বিপদ যদি এসে পড়ে/ সরব না,  ঘরের কোণে সরব না, দু বেলা  মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না/আমি ভয় করব না ভয় করব না॥"

ভয় করেননি তিনি। ১৩১২ বঙ্গাব্দের সেই উত্তাল সময়ে ডাক দিয়েছিলেন রাখি বন্ধনের। ধর্ম কিংবা পৌত্তিলকতাকে কোনওদিনই নিজের জীবনে স্থান দেননি রবীন্দ্রনাথ। তিনি বারংবার বলে গিয়েছিলেন  ‘আমার জীবনের মহামন্ত্র পেয়েছি উপনিষদ থেকে’। ব্রহ্মের কাছে বারংবার নতজানু হলেও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে স্থান দেননি কবি কোনও কালেই। তাই যে কলুষতা থেকে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লর্ড কার্জন তার বিরুদ্ধে সম্প্রীতির রাখিকেই হাতিয়ার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

কী ছিল সেই ইতিহাস?  

দিনটি ছিল ১৬ অক্টোবর ১৯০৫। বঙ্গভঙ্গের আইনের বিরুদ্ধে সকলকে একযোগে করে রুখে দাঁড়াতে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ বসু, শ্রী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, শ্রী বিপিনচন্দ্র পাল ডাক দিয়েছিলেন ঐক্যবন্ধনের। শহরজুড়ে বিলি হয়েছিল প্রচারপত্র। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর, ৩০শে আশ্বিন বাঙালির ঐক্যবন্ধনের দিন ঘোষিত হয়েছিল। সকলের হাতে রাখি পরিয়ে সংযম গ্রহণের ডাক দিয়েছিলেন। প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল,"ঐ দিন সমস্ত বাংলাদেশের কোথাও কোন গৃহে রন্ধন হইবে না। আমরা বাঙালিরা সেদিন উষ্ণ দ্রব্য ভোজন করিব না। বন-ভোজনের পারণের ন্যায় চিড়া মুড়কী, ফলাদি আহার করিয়া থাকিব৷ কেবল শিশুর জন্য দুগ্ধ জ্বাল দিতে অন্যত্র অগ্নি জ্বালিব চুল্লি জ্বালিব না। ঐ দিনকেই প্রতি বৎসর বাঙালির রাখি বন্ধনের দিন করিয়া স্মরণীয় করিয়া রাখিব।"

রানী চন্দ সম্পাদিত 'ঘরোয়া'-তে 'রবিকাকা'র সেই লড়াইকে ব্যক্ত করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কথায়,  "রবিকাকা একদিন বললেন, রাখিবন্ধন-উৎসব করতে হবে আমাদের, সবার হাতে রাখি পরাতে হবে।  ঠিক হল সকালবেলা সবাই গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখি পরাব। এই সামনেই জগন্নাথ ঘাট, সেখানে যাব— রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়। গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে, রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাথ অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে— মেয়েরা খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁক বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম – যেন একটা শোভাযাত্রা দিমুও ছিল সঙ্গে, গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে মিছিল চলল— বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥" রবীন্দ্রনাথের সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারেনি কেউ।

অবন ঠাকুরের কথায়, "ঘাটে সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য, রবিকাকাকে দেখবার জন্য আমাদের চার দিকে ভিড় জমে গেল। স্নান সারা হল— সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল এক গাদা রাখি। সবাই এ ওঁর হাতে রাখি পরালুম। অন্যরা যারা কাছাকাছি ছিল তাদেরও রাখি পরানো হল। হাতের কাছে ছেলেমেয়ে যাকে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না, সবাইকে রাখি পরানো হচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সে এক ব্যাপার। পাথুরেঘাটা দিয়ে আসছি, দেখি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতকগুলো সহিসকে হাতে রাখি পরিয়ে দিলেন রবিকাকা। রাখি পরিয়ে আবার কোলাকুলি, সহিসগুলো তো হতভম্ব। হঠাৎই রবিকাকার খেয়াল গেল চিৎপুরের বড়ো মসজিদে গিয়ে সবাইকে রাখি পরাবেন। হুকুম হল, চলো সব।  রওনা হলুম সবাই। গেলুম মসজিদের ভিতরে, মৌলবীদের হাতে রাখি পরিয়ে দিলুম। ওরা একটু হাসলে মাত্র।"

রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায় এই রাখি উৎসবের মন্ত্র বাতলে দিয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুর। শুধু তাই নয়, এই রাখিবন্ধন উৎসবকে সেই সময় পঞ্জিকাতেও স্থান দিয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন। যদিও পরবর্তীতে সময়ে সঙ্গে সঙ্গে সেই দিন মুছে যায়। তবু শ্রাবণের রাখি উৎসবেই বারবার ফিরে আসে রবিপ্রসঙ্গ। কারণ ভাই-বোনের সম্পর্কের বাইরেও সমাজকে একসুতোয় বাঁধার উৎসবই যেন রাখিবন্ধন।  

রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন সেদিন। সৌভ্রাতৃত্ব-সম্প্রীতিকে রাখির সুতোয় বাঁধতে পেরেছিলেন সকলকে। আগামী রবিবার শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা। শহরে ছেয়েছে নানা রঙের রকমারি রাখিতে। তবে কি কেবলই তা উৎসব হয়ে থাকবে দামী রঙিন সুতোর আড়ালে? না কি ধর্মকে গৌণ রেখে, সম্প্রীতি সৌহার্দ্যের বন্ধনই মুখ্য হয়ে থাকবে আজ ও আগামীতে?


তথ্যসূত্র-


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি, আত্মকথা-২, 'বঙ্গব্যবচ্ছেদ' প্রতিবেদন ও প্রচারপত্র, (রবীন্দ্ররচনাবলী পঞ্চদশ খণ্ড-খ বিবিধ) এবং  রাণী চন্দ সম্পাদিত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ঘরোয়া' (বিশ্বভারতী প্রকাশিত)।