নয়াদিল্লি: সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনায় সম্প্রতি মুখ খোলেন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়। তাঁর চেয়ে একধাপ এগিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে 'ধর্মযুদ্ধে' উস্কানি দেওয়ার জন্য দায়ী করলেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। 'সুপ্রিম কোর্ট নিজের সীমা ছাড়াচ্ছে' বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। দেশের শীর্ষ আদালত সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধির এমন মন্তব্য বেনজির। সেই নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিশিকান্তের মন্তব্যের দায় নিতে নারাজ বিজেপি। বরং নিশিকান্তের মন্তব্যের দায় ঝেড়ে ফেলেছে তারা। কিন্তু একের পর এক বিজেপি নেতা সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে মুখ খুলেই চলেছেন। (Nishikant Dubey)
সম্প্রতি সংসদ ভবনের অনুষ্ঠানেই সুপ্রিম কোর্টের নিন্দা করেন একদা বিজেপি-তে পদে থাকা ধনকড়, যিনি এই মুহূর্তে দেশের উপরাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যসভার চেয়ারপার্সন। রাজ্য বিধানসভায় বিলে অনুমোদন দেওয়া নিয়ে রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতিকে যে সময়সীমা বেঁধ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, তা মনঃপুত হয়নি ধনকড়ের। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা নিজেদের 'Super Parliament' মনে করছেন, সংবিধান প্রদত্ত আদালতের বিশেষ ক্ষমতা 'পরমাণু অস্ত্রে' পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য় করেন। (Supreme Court)
ধনকড়ের সেই মন্তব্য নিয়ে বিতর্কের রেশ কাটার আগেই শনিবার সুপ্রিম কোর্টেক বেনজির ভাবে আক্রমণ করতে শোনা যায় ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার বিজেপি সাংসদ নিশিকান্তকে। রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতিকে বিল আটকে রাখা নিয়ে যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, কেন্দ্রীয় সরকারের সংশোধিত আইন নিয়ে আপাতত যে নির্দেশ দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন নিশিকান্ত।
রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতিকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নিয়ে নিশিকান্তের বক্তব্য, "নিয়োগ কর্তৃপক্ষকে কী করে নির্দেশ দেয়? রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ করেন। সংসদ দেশের আই তৈরি করে। সেই সংসদকে নির্দেশ দেবে? নতুন আইন কী করে বানালেন? কোন আইনে লেখা রয়েছে যে রাষ্ট্রপতিকে তিন মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে? এর অর্থ হল, দেশকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যেতে চান। সংসদের অধিবেশনে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা হবে।"
সংশোধিত আইন নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট। ওয়াকফ বোর্ডে যদি ২২ জনের মধ্যে মাত্র আট জন মুসলিম হন, তাহলে হিন্দুদের বোর্ডে মুসলিমদের রাখা হবে কি না প্রশ্ন তোলা হয়। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, মহারাষ্ট্রে নয়া ওয়াকফ আইন নিয়ে বিক্ষোভও হয়েছে। সেই নিয়ে ওয়াকফ যৌথ সংসদীয় কমিটির জগদম্বিকা পাল জানান, যৌথ সংসদীয় এত কমিটির বৈঠকের পর. সংসদে পাস হওয়ার পর, রাষ্ট্রপতির সইয়ের পর যদি সংশোধিত আইনকে অসাংবিধানিক বলা হয়, তাহলে ইস্তফা দিয়ে দেবেন তিনি। সেই নিয়ে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্য়ায় তাঁকে ইস্তফা দেওয়ার পরামর্শ দেন। এতে নিশিকান্ত বলেন, "দেশে যত গৃহযুদ্ধ হচ্ছে, তার জন্য দায়ী প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না।"
এখানেই থামেননি নিশিকান্ত। তাঁর বক্তব্য, "দেশে ধর্মযুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট। নিজের সীমা ছাড়াচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট। সবকিছুর জন্য সুপ্রিম কোর্টে যেতে হলে, সংসদ এবং বিধানসভা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। একটা অনুচ্ছেদ ৩৭৭ ছিল, যার আওতায় সমকামিতা অপরাধ ছিল। আমেরিকা ট্রাম্প সরকারো জানিয়েছে, পৃথিবীতে লিঙ্গ দু'টিই।, নারী অথবা পুরুষ। ওরা সমকামী, রূপান্তরকামীর কথা বলেনি। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন সকলেই সমকামিতাকে অপরাধ মনে করে। কিন্তু এক সকালে সুপ্রিম কোর্ট বলে দিল, 'না, আমরা অনুচ্ছেদ তুলে দিচ্ছি'। অনুচ্ছেদ ৩৬৮ বলে আইন তৈরির অধিকার সংসদের। সুপ্রিম কোর্ট এখন নির্দেশ দিচ্ছে। আজ দেশ রাম, কৃষ্ণ, রাধা, সীতা, জ্যোতির্লিঙ্গ, সতীপীঠের। সনাতন আমাদের লক্ষ লক্ষ বছরের পরম্পরা। রামমন্দির, কৃষ্ণমন্দির, জ্ঞানব্যাপীর কাগজ দেখতে চায়। আর মিঘলদের পর যে মসজিদ হয়েছে, তার বেলায় বলা হয়, 'কাগজ কী করে দেখাবে?' এই দেশে ধর্মযুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার জন্য কেবলমাত্র সুপ্রিম কোর্ট দায়ী। সুপ্রিম কোর্ট সীমা ছাড়াচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের একমাত্র কাজ হল সংসদে তৈরি আইন ব্যাখ্যা করা।"
নিশিকান্ত একা নন, বিজেপি নেতা দীনেশ শর্মাও এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করেছেন। তাঁর কথায়, "দেশের সংবিধান অনুযায়ী, লোকসভা, রাজ্যসভা এবং রাষ্ট্রপতিকে কেউ নির্দেশ দিতে পারে না। রাষ্ট্রপতিকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে না, রাষ্ট্রপতি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।" শাসকদলের নেতারা যেভাবে সুপ্রিম কোর্টকে আক্রমণ করছেন, সেই নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্য়ায়ও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন। তাঁর কথায়, "আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান রক্ষার কথা বলেছে, আর সেই জন্যই ওয়াকফ আইন নিয়ে কেন্দ্রকে কিছু প্রশ্ন করেছে। এর ফলে পিছু হটেছে সরকার, কিছু ধারা প্রয়োগ করা হবে না বলে জানিয়েছে। আর সংবিধানের ৫৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সংবিধান মেনে কাজ করতে বাধ্য। তা না হলে, সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে নির্দেশ দিতে পারে। এর মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। এতে গণতন্ত্রেরই হাত মজবুত হয়। যা হচ্ছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বুঝতে হবে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন।"
এমন পরিস্থিতিতে দলের নেতাদের মন্তব্যে সাফাই দিতে এগিয়ে আসেন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। তাঁর কথায়, 'নিশিকান্ত দুবে এবং দীনেশ শর্মা বিচারব্যবসস্থা এবং প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তার সঙ্গে বিজেপি-র কোনও যোগ নেই। এগুলো তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত, বিজেপি এই ধরনের মন্তব্যের সঙ্গে একমত নয়, এই ধরনের মন্তব্যকে সমর্থনও করে না। এই ধরনের মন্তব্য পুরোপুরি খারিজ করছে বিজেপি। বিজেপি বিচারপতিদের সম্মান করে, তাঁদের নির্দেশ এবং পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করে, কারণ দল হিসেবে আমরা মনে করি, সুপ্রিম কোর্ট-সহ দেশের সব আদালত আমাদের গণতন্ত্রের অভিন্ন অংশ, সংবিধান রক্ষায় যাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ওই দু'জনকে এমন মন্তব্য করার নির্দেশ আমি করিনি'।
যদিও বিজেপি-র নির্দেশ ছাড়া নিশিকান্তরা এমন মন্তব্য করতে পারেন না বলে মত কংগ্রেস নেতা শ্রীনিবাস বিভির। তাঁর কথায়, 'নিশিকান্ত দুবের মতো সাংসদের এতটা ক্ষমতা নেই যে মালিকের নির্দেশ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট বা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তিনি মন্তব্য করেন। রামনাম জপে আর কত ছুরি চালাবেন নাড্ডা'?