কলকাতা: রানিকুঠিতে জিডি বিড়লা স্কুলে চার বছরের শিশুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ। ছবি দেখে দুই শিক্ষককে চেনাল শিশু। স্কুলে দফায় দফায় বিক্ষোভ অভিভাবকদের। সন্ধেয় গ্রেফতার দুই অভিযুক্ত শিক্ষক অভিষেক রায় ও মহম্মদ মফিজুদ্দিন। আইপিসি ও পকসো আইনে মামলা শুরু। এদিকে, চিকিৎসার পর হাসপাতালে থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি গেল নির্যাতিতা।
শিক্ষকদের ওপর ভরসা করেই এতদিন নিশ্চিন্তে স্কুলে পাঠাতেন। কিন্তু, বৃহস্পতিবার সেখানেই লোয়ার নার্সারির এই ছোট্ট পড়ুয়াকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে দু’জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার রাতেই থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ছাত্রীর বাবা। নির্যাতিত ছাত্রীকে ভর্তি করা হয় এসএসকেএমে। এই ঘটনার কথা জানাজানি হতেই শুক্রবার সকাল থেকে স্কুলের বাইরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন অন্য অভিভাবকরা।
গতকাল রাতে যাদবপুর থানায় স্কুলের পিটি শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিশুটির উপর শারীরিক অত্যাচার চালানোর অভিযোগ দায়ের করেন বাচ্চার বাবা, মা। কিন্তু আজ তদন্তের সময় পুলিশ জানতে পারেন, শিশুটির ওপর একজন নয়, দুজন মিলে অত্যাচার চালায়। গতকাল স্কুল ছুটির পর বাড়ি যাওয়ার সময় থেকেই শিশুটি কান্নাকাটি করছিল। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা জানায় আতঙ্কিত শিশু। এরপরই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান বাবা-মা। শিশুটির উপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে জানান চিকিৎসক।
এসএসকেএমের স্ত্রী রোগ বিভাগে চিকিৎসা হয় রানিকুঠির বেসরকারি স্কুলের ছাত্রীটি। তার মেডিক্যাল পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সকালে ৪ জন চিকিৎসক নির্যাতিতাকে পরীক্ষা করেন। হাসপাতালে ছিলেন ২ জন পুলিশ আধিকারিকও। এসএসকেএম সূত্রে দাবি, আইনি ব্যাপার হওয়ায়, সকালে মেডিক্যাল টেস্টের জন্য ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্য চাওয়া হয়। তাঁরা এসে শিশুকে পরীক্ষা করেন। উপস্থিত ছিল শিশুর পরিবার ও তাদের আইনজীবী।
সূত্রের খবর, প্রাথমিক রিপোর্টে ফরেন্সিক বিভাগ জানায়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয় দফায়, শিশুশল্য বিভাগের চিকিৎসকদের ডাকা হয়। তাঁরাও এসে শিশুকে পরীক্ষা করেন। পর্যবেক্ষণে বিশেষজ্ঞরা জানান, যৌনাঙ্গে ছোট একটি ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। এরপর স্ত্রী, শিশুশল্য ও ফরেন্সিক বিভাগের রিপোর্ট মিলিয়ে, একটি চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়। শুক্রবার বিকেলে হাসপাতাল থেকে শিশুকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
রানিকুঠির স্কুলে চাউল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্যরাও স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। সূত্রের খবর, বিষয়টি নিয়ে কমিটির সদস্যরা একটি রিপোর্ট জমা দেবেন বলে জানা গিয়েছে।বিষয়টি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকার। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ৩ জন সদস্য নিয়ে কমিটি তৈরি করা হয়েছে।
এদিকে স্কুলের মধ্যে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সকালের পর ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে স্কুল চত্বর।সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ তাঁরা স্কুলের ভিতরে ঢুকে পড়েন। সেসময় অবশ্য স্কুলের শিক্ষকরা এই ঘটনা প্রসঙ্গে কিছুই বলতে চাননি। এরপর কার্যত হাসতে হাসতে জনা কয়েকজন শিক্ষিকা সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেন! এক শিক্ষিকা বলেন, কেউ যদি দুষ্টুমি করে কী করা যাবে? আরেকজনের দাবি, আমাদের কাছে কোনও অভিযোগ আসেনি।
কিছুক্ষণ পর অধ্যক্ষা শর্মিলা নাথ বাইরে বেরিয়ে এসে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর দাবি, সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত স্কুলে ভাইস প্রিন্সিপ্যাল-সহ অন্যান্য শিক্ষিকারা ছিলেন। ওই সময় ছাত্রীটির কিছু হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর আরও বক্তব্য, নির্যাতিতার অভিভাবকরা স্কুলের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। ৫-৬ বছর ধরে অভিযুক্ত শিক্ষক ওই স্কুলে চাকরি করছেন বলেও দাবি করেছেন তিনি। এছাড়া গতকাল নির্যাতিতার কোনও পিটির ক্লাস ছিল না বলেও দাবি করেন প্রিন্সিপ্যালের। পুরো ঘটনার তদন্ত করে দেখবেন বলেও আশ্বাস দেন তিনি।কিন্তু, এত লজ্জাজনক একটা ঘটনায়, প্রিন্সিপালের এই রুটিন মন্তব্য শুনে আরও ক্ষোভে ফেটে পড়েন অভিভাবকরা। তাঁদের প্রশ্ন, স্কুলে মেল টিচার কেন ঢুকবে? এই ঘটনায় অধ্যক্ষার গ্রেফতারির দাবিও তোলেন অভিভাবকরা।
সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ বিশাল বাহিনী নিয়ে স্কুলে পৌঁছোন ডিসি এসএসডি রুপেশ কুমার। তিনি কথা বলে অভিভাবকদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। বলেন, কাল একটা ইনসিডেন্ট হয়েছে। ইনভেস্টিগেশন স্টার্ট হয়েছে। আপনাদের গ্রিভ্যান্স আছে, ম্যানেজমেন্ট নিয়ে, সিস্টেম নিয়ে, যা অভিযোগ থাকবে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু, লাভ হয়নি। কথার মাঝেই পুলিশকর্তার হাত থাকে মাইক কার্যত টেনে নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন অভিভাবকরা। অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুল ঘটনা চেপে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। অভিযোগ, ৩ বছর আগে ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর এই স্কুলেই এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। সেই ঘটনার পর সিসিটিভি বসানোর প্রতিশ্রুতি দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখনও তা বসানো হয়নি। ডিসি আশ্বাস দেন, আমি অ্যাসিওর করছি, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও, সকাল ১১টা নাগাদ পরিস্থিতি ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফের স্কুলের ভিতর বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন অভিভাবকরা। এই সময় একটি খালি স্কুলবাস স্কুলে ঢুকতে গেলে, তা ঘিরেও শুরু হয় বিক্ষোভ। স্কুলবাসের গায়ে লাথি মারতে শুরু করেন অভিভাবকরা। এরপর দুপুরের দিকে স্কুলে যান নির্যাতিত ছাত্রীর বাবা। তাঁর সঙ্গে ভিতরে ঢুকে যান অন্য অভিভাভকরাও। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নির্যাতিত ছাত্রীর বাবা।
তিনি বেরিয়ে গেলেও, বিকেল পর্যন্ত দফায় দফায় চলে বিক্ষোভ। এরইমধ্যে এক শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মী স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে ঘিরে ধরেন অভিভাবকরা। উত্তেজিত অভিভাবকদের প্রশ্ন, আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? আপনার বাচ্চার সঙ্গে হলে কী করতেন? যদি অন্যের মেয়ে হত দাঁড়াতেন না? একজন অশিক্ষক কর্মী স্কুল থেকে বেরোতে গেলে তাঁকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়।
শ্লীলতাহানির ঘটনায় চাঞ্চল্যকর দাবি করে নির্যাতিতা শিশুর আইনজীবী। আইনজীবীর দাবি, শিশুটির ওপর একজন নয়, দুজন মিলে যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল। প্রথমে শিশুটিকে চকোলেটের লোভ দেখিয়ে শৌচাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখানে তাঁর লেগিংস ও অন্তর্বাস খুলে যৌন নির্যাতন চালানো হয়। যার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে মেডিক্যাল রিপোর্টে। আজ হাসপাতালে পুলিশ যখন চারজনের ছবি নিয়ে বাচ্চাটির কাছে গিয়েছিলেন, তখন শিশুটি দুজনকে চিহ্নিত করে। তাদের 'দুষ্টু স্যর' বলে চিনিয়ে দিয়েছিল দুধের শিশুটি।
অভিযুক্তদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। সূত্রের খবর, যাদবপুর থানায় অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নির্যাতিতার বয়ানের সঙ্গে অভিযুক্তদের বয়ান মিলিয়ে দেখা হয়। শিশুদের ওপর যৌন নিগ্রহ মোকাবিলা আইন বা পকসো আইনে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। দফায় দফায় জেরার পর তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আইনের ৪ ও ৬ ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ।
পকসো আইনের ৫ নম্বর ধারার ৬ নম্বর উপধারা অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের করা যায়। অ্যাগ্রাভেটেড পেনিট্রেটিভ সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট। কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠাবনে স্টাফ যুক্ত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ধারা প্রযোজ্য হয়। এই ধারায় ন্যূনতম সাজা ১০ বছরের জেল ও জরিমানা। সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন।