মহুয়ায় মাতাল ছিল

ওয়েব ডেস্ক, এবিপি আনন্দ Updated at: 03 Dec 2016 07:10 AM (IST)

এক সময়ের টালিগঞ্জ। তুখড়় সুন্দরী, মরমি অভিনেত্রী, ফুটবল ভক্ত, বেপরোয়া প্রেমজীবনের মহুয়া রায়চৌধুরী। অগ্নিদগ্ধ হয়ে তাঁর চলে যাওয়া আজও রহস্য। লিখছেন দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়


১৯৮৫।


সে এক আষাঢ় শেষের বেলা। বিরামহীন বৃষ্টি।

দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত নার্সিং হোমের আট তলায় ৭২২ নম্বর ঘর।

ঝলসানো শরীর অস্ফুট উচ্চারণে শুধু কয়েকটা শব্দ শোনা গিয়েছিল, ‘‘আমার গোলা রইল। ওকে দেখিস।’’

না, কোনও প্যারালাল সিনেমার দৃশ্য নয়।

এ এক জীবনের দলিল।

যে জীবনের নাম মহুয়া রায়চৌধুরী।

‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এ ঘোড়সওয়ার হয়ে যে মেয়েটা বাংলা ছায়াছবিতে এসেছিল। সে এক আবির্ভাব যেন!

এক্কেবারে আসা, দেখা, জয় করা। তবে কিনা নিজস্বতা বজায় রেখে। তার পরই দ্রুত প্রস্থান।

ঘোর বর্ষামুখর রাতেই ভয়ঙ্কর ভাবে আগুনে পুড়ে এগারোটা দিন মৃত্যুর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষ করে অগুনতি মানুষকে চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিয়েছিল সে।

চলে গিয়েছিল স্বামীপুত্রের ভরাট সংসার ফেলে, বাংলা চিত্রজগতের নির্দেশক প্রযোজকদের এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে।

ঠিক তার আগে প্রাণের বন্ধু মাটুর হাত ধরে সাত বছরের গোলার কথা বলে যেতে পেরেছিল শুধু।

আত্মহত্যা না হত্যা?

নাকি নিছকই দুর্ঘটনা?

এ সংশয় রয়ে গেছে আজও।



ফেরা যাক বহু যুগ আগের সেই সন্ধেবেলায়।

আসর বসেছে উত্তর কলকাতার চৌধুরীপাড়ায়। সে আমলে এমনি অস্থায়ী স্টেজেও স্বনামধন্য শিল্পীরা অংশ নিতেন।

দর্শক আসনে হাজির স্বয়ং সুচিত্রা সেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল মিত্রর মতো অদ্বিতীয় শিল্পীরা।

অনেক কষ্ট করে এখানেই জনৈক নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী তাঁর ছোট্ট সাত বছরের মেয়ে শিপ্রার নাচ দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন।

নীলাঞ্জন এক সময় নিজে উদয়শংকরের দলে নাচতেন, নামী এডিটরের শাগরেদি করেছেন, মায় বম্বে পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছেন যশের আশায়, অর্থের সন্ধানে।

লাভ হয়নি।

ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। কনিষ্ঠা কন্যা শিপ্রা তখন সবে চার বছরের শিশু। তাতে কী! যে কোনও গানের সঙ্গে সে সারা বাড়ি প্রজাপতির মতো নেচে বেড়ায়। স্তম্ভিত হতে হয় তার তালজ্ঞানে!

এক দুঃসাহসী চিন্তা মাথায় এল নীলাঞ্জনের। ক্যারিকেচার আর্টিস্ট বেণু সেন ছিলেন ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁকে মনের কথা জানালেন। অতঃপর চৌধুরীপাড়ার আসর।

সেদিনের সেই প্রমোদমেলায় হেমন্ত, সন্ধ্যা, শ্যামলের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিল ছোট্ট শিপ্রা।

আর শার্গিদ-এর ঝমঝমে গান— দিল ভিল, প্যার প্যার, ম্যায় কেয়া জানু রে’র তালে তালে জন্ম হল ছন্দিত সোনালি রায়ের।

মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকরা সে দিন জানতেও পারেননি তাঁরা এক ইতিহাসের সাক্ষী রয়ে গেলেন। এক তারার জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলেন।

বেশ কিছু দিন সোনালি রায় কলকাতা আর তার আশপাশে অস্থায়ী স্টেজ মাতিয়ে রাখল।

পয়সা রোজগারও শুরু হল ওই পুতুলখেলার বয়স থেকেই। তারপর স্টেজ এবং বাবার টালিগঞ্জ পাড়ার যোগাযোগের সুবাদে এক দিন গুটি গুটি পায়ে হাজির হল স্টুডিয়ো পাড়ায়।

সুখেন দাসের প্রযোজনায় পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় !নয়া মিছিল’ ছবির জন্যে নায়িকার খোঁজ চলছে।

জহুরি সুখেন দাসের খাঁটি সোনা চিনতে ভুল হয়নি। কিন্তু বিধি বাম। নির্দেশকের ওই চরিত্রের উপযুক্ত মনে হল না রোগাসোগা সোনালি কিংবা শিপ্রাকে।

বাবার হতাশা দেখে ছোট হলেও অপমান বড় বেজেছিল!

স্টুডিয়ো চত্বর ছেড়ে ভগ্নমনোরথ বাপ-মেয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। পিছু ডাকলেন সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিগত মেকআপ-ম্যান জামালভাই।

খবর পাওয়া গেল তরুণ মজুমদার তাঁর আগামী ছবির জন্যে অল্পবয়সি নতুন মুখ খুঁজছেন। আবার আশার আলো।

কনেবউ সেজে সন্ধ্যা রায়, তরুণ মজুমদারের সামনে দাঁড়াল সদ্য কৈশোর-পাওয়া শিপ্রা ওরফে সোনালি।

মাত্র তেরো বছর বয়স। নামকরণের তখনও কিছু বাকি ছিল। শ্রীমান পৃথ্বীরাজ-এর বউ থেকে প্রেয়সী হবার যাত্রা শুরু হল নতুন নামে।

বাংলা চলচ্চিত্রে নায়িকা অধ্যায়ে নবতম সংযোজনের নামকরণ করা হল মহুয়া রায়চৌধুরী।

কাঁচামাটির তাল নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন সন্ধ্যা রায়! অস্থায়ী স্টেজের অখ্যাত এক রোগাসোগা শিশুশিল্পীকে অপত্য স্নেহে অভিনয়ের পাঠ থেকে শারীরিক যত্নে লালন করা। তবু আজ অনায়াসে বলেন, ওকে কিছু শেখাতে হয়নি। আমি শুধু পড়ে দিলাম। বাকিটুকু ও নিজেই তরতর করে বলে গেল।

নাচ, অভিনয়, সবই ছিল ওর জন্মগত প্রাপ্তি। দুরন্ত, চঞ্চল তেরো বছরের বালিকা যখন পার্ট বুঝত, চরিত্র শুনত তখন একবারে স্থির এবং আত্মমগ্ন। তাঁর ভাষায় মহুয়া এক ‘লিটল গ্লোরিয়াস টুইলাইট’।

মাধবী চক্রবর্তী ছিলেন তার মাধুমা। ভাত না খেয়ে কাজে বেরোতে পারত না। দূর দমদম থেকে ভোরের কল টাইমে হাজির হতে হলে, নির্দ্বিধায় থেকে যেত মাধুমার কাছে।

‘‘সকাল সকাল দুটো ভাত রান্না করে দিতাম। খেয়ে বেরোত। আমারও শান্তি হত,’’ সেকালের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না নায়িকা ঘরোয়া মা-মাসির মতোই অপার স্নেহমাখা মুখে বললেন।

বলতে বলতে বিষণ্ণতার আকুল করা ব্যথা চারিয়ে উঠল যেন টলটলে চোখের পাড়ে— ‘‘সাবুর মতো অভিনয়ের ধরন ছিল। অমনি স্বচ্ছন্দ, অমনি আন্তরিক। ও চলে যাবার পর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিল। সেটা তপন সিনহার কাছেই রয়ে গেল। ওর বাড়ির কেউ ওর হয়ে নিতেও আসে নি। অভিমান, অবহেলা নাকি আশঙ্কা? কেউ জানি না।’’

তাপস পাল, সন্তু মুখোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিক, দীপংকর দে ছিলেন সমসাময়িক নায়কের দল।

সন্তু মুখোপাধ্যায়ের গলা থেকে অপরিসীম মমতা ঝরে পড়ল।— ‘‘স্টুডিয়োর কুকুরগুলো পর্যন্ত ছিল ওর ভক্ত। একবার ঢুকতে দেখলেই হল— সার বেঁধে পেছন পেছন ফ্লোর পর্যন্ত চলে আসত। কী যে হই চই করে জমিয়ে রাখত কী বলব!’’

‘দাদু নাতি হাতি’ বলে একটা ছবি করেছিল। স্বভাবতই একটি হাতি ছিল তাতে। প্রতিদিন নিয়ম করে এক ছড়া কলা নিজে হাতে তাকে খাওয়াত।

সন্তু বলছিলেন, ‘‘ওর সঙ্গে শট দিতে গিয়ে সময়-সময়, সত্যি বলছি, কেমন যেন, অস্তিত্বের সংকট হতো। ওকে শুধু অভিনেত্রী বললে কম বলা হয়। ও ছিল জাত শিল্পী।’’

শুধু পশুপাখি বলে নয়, নির্বিচারে সবার জন্য ভালবাসার অনন্ত এক জমি যেন মনের মধ্যে বয়ে বেড়াতেন মহুয়া!

এই ইন্ডাস্ট্রির প্রতি কোণে তো আলো পৌঁছয় না। মহুয়ার ডান হাতটা যেন সব সময় বাড়ানোই থাকত ওই আলো না-পৌঁছনো কোণগুলোর আনাচেকানাচে। সেখানে জড়োসড়ো হয়ে কোনও ক্রমে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জন্য।

শ্রীলা মজুমদার।

মাত্র এক দিনের আলাপ।

একবার কাজের কথাও হয়েছিল একসঙ্গে। মহুয়া তখন ব্যস্ত নায়িকা। সময় দিতে পারেননি।

‘‘প্রায় এক বছর বাদে ভোরবেলা বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি। একটা গাড়ি এসে হঠাৎ দাঁড়াল। কাচ নামিয়ে কে যেন ডাকছে! এক ঝলক দেখে হঠাৎ করে চিনতে পারিনি। মেকআপ করা একটা মুখ। তার পরই  বুঝলাম, ওম্মা! মহুয়াদি! অনেক দিনের পরিচয় থাকলে যেমন করে মানুষ কথা বলে, ঠিক তেমনি করে আমায় ডাকলেন, ‘কোথায় যাবে? উঠে এসো শিগগির।’’’

‘দাদার কীর্তি’। তাপস পাল প্রথম ফ্লোরে এলেন। এতটাই কাঁচুমাচু জড়োসড়ো ভঙ্গি, যে পাঁচ বছরের শিশুটিও মুখের ভাষা পড়ে ফেলেছিল।

‘‘প্রথম প্রথম সকলেরই একটু অমন হয়। পরে সব ঠিক হয়ে যায়।’’

কার আশ্বাসবাণী?

নবাগত ছেলেটি অবাক হয়ে ফিরে দেখে, বাংলা ছবির ব্যস্ততম নায়িকার মুখ!

ছবিতে মহুয়ার ছোট বোন ছিল দেবশ্রী, স্টুডিয়োপাড়া যাকে চেনে চুমকি নামে। গোপন কথা, বকাবকি, আদর, মান-অভিমান সবটা জড়িয়ে অজান্তেই কখন যেন চুমকির ‘দিদি’ হয়ে যান মহুয়া।

একবার রীতিমত মনকষাকষি।

আশেপাশে যাঁরা ওঁদের জানতেন, তাঁদের আশংকা নায়িকার সঙ্গে নায়িকার এমন বিরল সদ্ভাব এ বার বুঝি আর থাকে না!

কিন্তু মহুয়া তো মহুয়াই।

কখন যে ঝোড়ো হাওয়ার মতো সব উড়িয়ে দু’হাত দিয়ে ফের আগলে ধরলেন তাঁর অভিমানী ‘বোন’-কে, টেরই পাওয়া গেল না।

মহুয়ার সব নায়ক অবশ্য আজ আর তাঁর প্রতি সমান সহমর্মী নন।

এঁদেরই এক জন তো মহুয়া প্রসঙ্গে লেখালেখির যথার্থতাই খুঁজে পেলেন না। প্রায় ঠাট্টা করেই উড়িয়ে দিলেন।—‘‘মহুয়া! এটা একটা বিষয় হল!’’

মহুয়াকে স্বহস্তে যাঁরা প্রায় রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ আবার ওঁর সম্পর্কে একান্তই ব্যক্তিগত স্মৃতি ‘বাজার’-এ এনে ফেলতে চাইলেন না।

কেউ যেন এড়িয়ে গেলেন।

ভয়? আজও? অনিশ্চয়তা এখনও? পাছে নিশ্চিত জীবনে বেয়াড়া আঁচ়ড় লেগে যায়!

কে জানে!

প্রেম ছাড়া না কোনও শিল্প হয়, না কোনও শিল্পী বাঁচে!

এক রত্তি মহুয়াও প্রেমে পড়ছিল তিলকের।

কিশোরকণ্ঠী তিলক তখন স্টেজে গান গায়। কোনও এক বৈশাখের দখিন হাওয়ার দোলায়, নাকি সেই প্রহর শেষের চৈত্রের রাঙা আলোয় দেখা হয়েছিল, সে আজ সময়ের অতলান্তে হারিয়ে গিয়েছে।

বাড়ির মত ছিল না। এ দিকে বাঁধা পথে চলবার মেয়ে সে যে নয়। সহায় তখন মাটু। জনগণের চোখে যিনি কিনা অভিনেত্রী রত্না ঘোষাল। উজিয়ে এলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণকুমার... আরও অনেকে।

মেয়ের এই সিদ্ধান্ত বাবা মেনে নেননি। কেন নেননি? কেউ বলেন, মেয়ের সামনে তখন প্রসারিত ভবিষ্যৎ। অপরিমেয় কাঞ্চনযোগ। অতি সাধারণ মধ্যবিত্তের পক্ষে তার হাতছানি অগ্রাহ্য করা নিশ্চিত কঠিন। এ ছাড়া রঙিন পৃথিবীর কাজল যার চোখে, খ্যাতির মোহপাশ সে বড় সহজে কাটাতে পারে না।

শিপ্রা থেকে মহুয়ার যাত্রাপথের যে আয়োজন স্বহস্তে করেছিলেন, তার ‘ভাগিদার’ মেনে নেওয়া হয়তো’বা সেদিন সম্ভব ছিল না নীলাঞ্জনের।

হার মানলেন জেদি মেয়ের কাছে!

তিলকদের হেদুয়ার পুরনো বাড়ি। তুলনায় সচ্ছল। ব্যাংকের চাকুরে।

শুরুটা ছিল ভারী সোহাগের।

তিলকের দাদা অলোক চক্রবর্তী ওঁদের দুজনকে নিয়ে প্রযোজনা করলেন ‘আনন্দমেলা’।

ছবি চলল না।

কিন্তু মহুয়ার ডাক আসতেই লাগল অন্য পরিচালকদের কাছ থেকে।

দু’জনে মিলে উঠে এল টালিগঞ্জের বাসাবাড়িতে। অল্প বয়স। বায়োস্কোপের পাত্রপাত্রী।

মাঝরাতে বাইকভ্রমণ।

মদ্যপান।

ফুর্তির ফোয়ারা।

এরই মধ্যে এল ফুটফুটে পুত্রসন্তান।

মহুয়ার ফুটবলপ্রীতি ছিল যখন ও শিপ্রা, তখন থেকে।

দাদা যখন মাঠে খেলতে যেত পিছন পিছন সঙ্গ নিত ছোট বোন।

মন দিয়ে খেলা দেখত মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে।

কখনও খেলোয়াড় কম পড়লে নিজেই মাঠে গোল আগলে দাঁড়াত। অন্য দলের এগিয়ে আসা প্লেয়ারদের রীতিমত শির-ফোলানো গলায় শাসাত। —‘‘খবরদার! যদি আমাকে গোল দিয়েছিস। দেখে নেব, পরে।’’

কী দুর্জয় সাহস! টগবগে প্রাণ! কী নিবিড় মনের বেড়। যা আমার, তা আমারই। জীবনে-মরণে, সতে-অসতে আমি তাকে রাখব।

রাখবই রাখব।

ইস্টবেঙ্গল হেরে গেলে মাথা কুটে কাঁদে।

আর তার আবেগের আধার? সে যেন অকুল দরিয়া! অসীম, অনন্ত। যা কিছু আপন, তার জন্য জান কবুল আর মান কবুল।

পেলেকে নিয়ে কসমস ফুটবল দল এল কলকাতায়। মোহনবাগানের সঙ্গে খেলতে।

’৭৭ সাল।

গড়ের মাঠে খেলা হল সেপ্টেম্বরের চব্বিশ। মায়ের জন্মদিনের দিনই ভূমিষ্ঠ হল মহুয়ার ‘গোলা’।

চতুর্দিকের ‘গোল গোল’ আওয়াজের তোড়ের মধ্যে যে মায়ের কোল আলো করল, পাঁড় ফুটবল ভক্ত তার কী নাম দেবে?— ‘গোলা’।

মহুয়া নায়িকা হয়েও দর্শকের কাছের মানুষ। ওর সাধাসিধে স্বতঃস্ফূর্ত আনাগোনা চলাফেরার মধ্যে একটা আটপৌরেপনা থেকেও কোথায় যেন সে অনন্যা।

তত দিনে তিলক-মহুয়া উঠে এসেছে বেহালায়। সব বিবাদ চুকিয়ে বাবাও এসে বাস করতে শুরু করেছেন মেয়ের ঘরে।

কচি গোলাকে দেখভাল করতে হবে তো! কিন্তু তা’তেও জীবন সুরে বাজল কই!

দুনিয়ার সব আলো তখন মহুয়ার জন্য। আশেপাশের কেউই সেই ছটার ধারেকাছেও নেই।

প্রযোজক ‘অগ্রগামী’ থেকে নির্দেশক নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়, তপন সিংহ সবাই ওর কথা ভাবতে শুরু করেছেন।

ওই মায়াময় দুটো চোখ, ঝিকিয়ে ওঠা হাসি, এক ঢাল চুল, ভেসে থাকা এক পানপাতা মুখ।— সবটা মিলে যেন ঠিক মানবী নয়!




প্রথম জীবনে রোগা বলে বাদ পড়েছিল ‘নয়া মিছিল’ থেকে। বুকের মধ্যে সেই তুষের আগুন নিভতে দেয়নি।

তাই পৃথুলা বলে যখন তপন সিংহ ‘আদমি ঔর আউরত’ থেকে বাদ দেবেন বলে ঠিক করলেন, মহুয়া মাত্র তিন সপ্তাহ সময় চেয়েছিল।

যথাসময়ে যখন তপন সিনহা তাকে দেখে, এক রকম অবাক হতেও ভুলে গিয়েছিলেন।

দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জয় করে বৃত্ত যখন সম্পূর্ণ করল, তত দিনে শুধুমাত্র চন্দ্রাভ সে মুখের স্মৃতিভারটুকু রেখে পুরস্কারের পাশে ‘মরণোত্তর’ কথাটুকু বসিয়ে দিয়ে মহুয়া চলে গেছে চিরকালের মতো। সব মায়ার ও পারে।

তিলক ছিল ছেলেবেলার বন্ধু। ওদের প্রেম কৈশোরের। ভালবাসার অভাব ছিল না। ছিল প্রাত্যহিক বোঝাপড়ার অভাব।

এই জুটিটির পরম বন্ধুর সে দিনের কথা বলতে বসে আজও গলা ধরে আসে।

রত্না ঘোষাল।

বললেন, ‘‘মৌয়ের মনটা ছিল বিরাট। কিন্তু ...।’’

গলায় স্তব্ধতা নেমে আসে।

‘‘মদ মৌ খাবেই আর...।’’ আবারও নিশ্চুপ।

আর?

‘‘আর মদ খেলেই কেমন যেন পালটে যেত। পুরুষ চাই তখন। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কী যে করত, কী বলত, কোথায় পৌঁছত, তার কণামাত্র মনে থাকত না। পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শিশুর মতো জিজ্ঞেস করত— ‘সত্যি মাটু আমি এরকম করেছি? কেন করলাম বল তো?’ সেই সরলতা আরোপিত নয়। কার সাধ্য তাকে অস্বীকার করে!’’

তিলককে তবে কি ধরিত্রীর মতো সহনশীল হতে হয়েছিল?

সেই ধৈর্যের রাশ আলগা হয়েই কি দুর্ঘটনা?

কীসের থেকে এই বেপরোয়া জীবনযাপন?

শেকড় ছেঁড়া দোলাচল?

অতি সাধারণ পরিবার থেকে হঠাৎ পাওয়া খ্যাতি, দুরন্ত আবেগ অথচ সাধারণ মেয়ের মতো স্বামী সংসারের আকাঙ্ক্ষার অনিয়ন্ত্রিত আন্দোলনে পায়ের তলার জমিটা কি বড় নরম হয়ে গেছিল?

নাকি শৈশবে বিকৃতি আর লালসার শিকার হওয়া সংবেদনশীল মনটা রক্তাক্ত হচ্ছিল বারবার?

একাধিকবার মহুয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। মহুয়ার মাধুমা আর মাটু দুজনেরই চোখ সজল হয়ে এল, গলা ধরে এল এ কথা স্বীকার করে নিতে গিয়ে।

এক বুক শূন্যতা থেকে সুরাসক্তি। যে আসক্তি পৃথিবীর কাউকে কোনও সুস্থ জীবন দেয়নি।

গড়পড়তা মাপকাঠিতে এ চরিত্রের তল পাওয়া অসম্ভব।

তা’হলে এ কি শুধুমাত্র এক শিল্পীর অনন্ত খোঁজের তাড়না? অতি তীব্র আবেগের ভার? বঞ্চিত ছেলেবেলার যন্ত্রণাবোধ? নাকি মানসিক রোগ!

নাকি কোনও একটি নয়, সবই আছে একত্রে?

বহমান সময় আর নদীর জল কারও জন্য অপেক্ষা করে না, করেওনি।

নায়িকারা এসেছে, আসছে, আসবেও।

যে দর্শককুল তাঁকে যথাসময়ে পর্দায় দেখেছিলেন তাঁদের বুকের খুব কাছটাতে ওই প্রাণেশ্বরী কেন যেন বড় আলাদা করে নিজের জায়গাটুকু আগলে রেখেছে। এখনও, আজও।

কোনও অবেলায় একলা বসে কেউ বুঝিবা ভাবেন, এই তো সেই মুখ, যাকে দেখে কেবলই মনে হয়—

ওই মেয়েটির কাছে, সন্ধ্যাতারা আছে!




 

- - - - - - - - - Advertisement - - - - - - - - -

© Copyright@2024.ABP Network Private Limited. All rights reserved.