‘ভারতবর্ষের জনগণের সিংহভাগের টাকা এতটাই সাদা, রক্তাল্পতায় ভুগছে’

ওয়েব ডেস্ক, এবিপি আনন্দ Updated at: 19 Nov 2016 07:35 AM (IST)

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়





স্টেট ব্যাঙ্কের যে শাখাটিতে আমার বত্রিশ বছরের পুরনো অ্যাকাউন্ট, সেটা আমার ঘরবাড়ির অংশ বলেই বিবেচনা করার কথা। চেনা ব্যাঙ্ক বা পুরনো ব্যাঙ্কের সঙ্গে মানুষের একটা আত্মীয়তাও তো গড়ে ওঠে। কিন্তু মাঝে মাঝেই পাইকারি বদলির ঠেলায় চেনা ব্যাঙ্কটা অচেনা হয়ে যায়। হঠাৎ এক দিন গিয়ে দেখি, একটিও চেনা মুখের কর্মচারী চোখে পড়ছে না। কেউ হেসে বলছে না, ‘আরে আসুন, আসুন। কী খবর?’ কিংবা ‘ভাল আছেন তো?’ সর্বত্রই আমরা, বিশেষ করে বাঙালিরা, চেনা মুখ দেখতে ভালবাসি। সে বাজারের সব্জিওয়ালা, মাছওয়ালা, মুদির দোকানি থেকে রিকশাওয়ালা বা চাওয়ালা— যে-ই হোক। আর চেনা মুখ না দেখলে একটা অস্বস্তি হয়। যেমন বৃহস্পতিবার আমার হয়েছিল।

এটিকে মোটামুটি গরিবের ব্যাঙ্ক বলা যায়। এর অবস্থান গোবিন্দপুরের বিশাল বস্তি অঞ্চল ঘেঁষে। ছোট ব্যাপারি, খেটে খাওয়া মানুষ, মুটে-মজুরদের ব্যাঙ্ক বললেই ঠিক হয়।

টাকার যে কোনও ক্যারেক্টার নেই, তা আমরা জানি। কারও হাতে থাকলে কালো, কারও হাতে থাকলে ভাল। অনেক দিন আগে আমি এক বার একটা টাকার ক্রয়-ক্ষমতা কত, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করেছিলাম। এক জন এক টাকায় দুই আঁটি ধনেপাতা কিনল। ধনেপাতাওয়ালা সেই এক টাকায় আলুর চপ কিনে খেল। চপওয়ালা সেই টাকায় কিনল বিড়ি। আর এই ভাবেই দেখা গেল, একটা টাকা সারা দিনে হাত-ফেরতা হয়ে হয়ে তিরিশ-চল্লিশ টাকার কেনাকাটা করে ফেলেছে এবং পরের দিন আরও তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকার কেনাকাটা করে ফেলবে এবং দিনশেষে তবু তার মূল্যমান সেই এক টাকাই রয়ে যাবে। এত কেনাকাটার কোনও খতিয়ান তার গায়ে লেখা থাকবে না। অর্থাৎ কি না রমতা যোগী, বন্ধনমুক্ত, যে কোনও মায়ায় জড়ায় না। যেমন গড়ানে পাথরে জমে না শ্যাওলা। যে টাকা ঘুরে বেড়ায়, বারবার হাত-ফেরতা হয়, সে হল ভাল টাকা। সুবোধ বালক। আর যে টাকা কারও খপ্পরে পড়ে কোনও কোনা-ঘুপচিতে গা-ঢাকা দিয়ে ভ্যানিশ হয়ে থাকে, সে হল সন্দেহজনক। তারও হাতবদল হয়। চলে কেনাকাটা এবং লগ্নিও। কিন্তু সবটাই অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে। নভেম্বরের ৮ তারিখ রাতে তাদের এই অজ্ঞাতবাস শেষ হল কি না, সেটাই বোঝার  চেষ্টা   করছি  ক’দিন  ধরে।

এটা ঠিকই, কালো ও ধলো দুই ভাই-ই পাশাপাশি বাজারে চালু আছে। এবং বিদগ্ধ ব্যক্তিরা বলেন, দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকারও কিছু অবদান থাকে। ফলে, সমান্তর দু’টো টাকাকে কালো আর ধলো বলে চিহ্নিত করা অতিশয় কঠিন। সুতরাং আমরা, আমজনতা, ‘অ্যাভারেজ’ বুদ্ধির অধিকারীরা ফের অগাধ জলে।

যাদের কাছে কালো টাকা আছে, তারা যদি সেই টাকা পুড়িয়ে ফেলে, তা হলে নাকি আখেরে সরকারের লাভ হয়। কারণ, সরকারকে ওই টাকার ব্যয়ভার আর বহন করতে হয় না। এই জটিল সব তত্ত্ব বুঝি না বলেই এবং অর্থনীতি অতীব জটিল মনে হওয়ায় আমার আর দেশের অর্থমন্ত্রী হওয়া হল না। এক বার ব্যাঙ্কের এক সুন্দরী কর্মচারীর সামনে বসে একটা সহজ যোগ অঙ্ক তিন বার কষে তিন রকম যোগফল হওয়ায় সুন্দরীটি করুণার হাসি হেসে আমার কাগজটি নিয়ে খুব হেলাফেলায় যোগটি কষে বলেছিলেন, ‘আহা, ভুল তো সকলেরই হয়।’ ভারী লজ্জা পেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, কেন আমি কখনওই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হতে পারিনি। আর যে দিন আমি বাজার থেকে লকলকে পুঁইশাক এনেছিলাম, কিন্তু সঙ্গে কুমড়ো আনতে ভুল হয়েছিল, সে দিন আমার বৌয়ের কিছু অম্লমধুর মন্তব্য শুনে আমার চোখের ঠুলি খসে পড়েছিল। কেন আমাকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি, তা জলবৎ বুঝতে পেরে যাই। এই আমি, মানে আমরা, অর্থাৎ দেশের আম জনগণের এই খামতিগুলোই আমাদের বোকাসোকা জনগণ করে

রেখেছে। আমরা সব কিছু ভাল বুঝি না ঠিকই, কিন্তু আমরা বুঝতে চাই।

আমি কখনও সখনও বুদ্ধিজীবী, ঝকঝকে, লেখাপড়া জানা, চটকদার মানুষজনের সঙ্গে বসবার সুযোগ পাই বটে, কিন্তু তাঁদের কথাবার্তার অনেকটাই আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। ঘাই মারে না, অর্থাৎ বুঝতে পারি না। যেমন বুনুয়েলের ছবি, পোস্ট মডার্নিজম, আরও কত কী। আমার বৌমা মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘হ্যাঁ গো বাবা, কী বললাম বুঝতে পারলে?’ অর্থাৎ, আমার সম্পর্কে সন্দিহান মানুষের অভাব নেই। কিন্তু আমি ভারি ভাল বুঝতে পারি, রোজকার কিছু বন্ধুর কথাবার্তা। তাদের কেউ বাজারে সব্জি বিক্রি করে, তালতলার মাঠের কাছে এক জনের চায়ের দোকান, এক জন সেখানে রাস্তায় পার্কিং ফি আদায় করে এবং এ রকম আরও অনেকে। একই শ্রেণির মানুষজন। চাওয়ালা অনিল মাঝে মাঝেই আমাকে তার দোকানের চা খাওয়ায়। পয়সা নেয় না। কয়েক দিন আগেই এক বিকেলে সেই অনিল আর পার্কিং ফি আদায়কারী বলরাম আমায় ঘিরে ধরেছিল, ‘আচ্ছা, এই যে মোদীজি নোট বাতিল করলেন, এতে কি আমাদের ভাল হবে? জিনিসপত্রের দাম কমবে? কালো টাকা কি সব বেরিয়ে পড়বে?’ আমার মতোই তারাও বুঝতে চাইছে, তার কারণ, তারাও আমার মতোই, ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। বলাই বাহুল্য, আমাকেও মাঝে মাঝে বিজ্ঞ লোকের ভূমিকা নিতে হয়। বিজ্ঞ নই, তা জেনেও। তবে দু’চার দিনের মধ্যেই বুঝলাম, আমার শঙ্কিত হওয়ার তেমন কোনও কারণ নেই। যে কাণ্ডটা হল, তা অনেক বড় বড় বুদ্ধিজীবীও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁদের মুখের বিপন্নতাই সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

ব্যাঙ্কের কথাটা এ বার বলি। আমার পুরনো ব্যাঙ্কে অচেনা মানুষজনের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে চার দিকে মেলা উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু রাগত বা বিরক্ত মুখ একটিও নয়। বাঙালির এত ধৈর্য এবং শৃঙ্খলাবোধ বহুকাল দেখিনি। আর কর্মচারীদের এমন দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করার দৃশ্য শেষ কবে দেখেছি, মনে পড়ে না।

সিদ্ধান্তটা ঠিক না ভুল, তার বিচার কালক্রমে হবে। কিন্তু আপাতত এই সিদ্ধান্তে জনগণকে অখুশি একেবারেই দেখাচ্ছে না, বিস্তর হয়রানি পোহানো সত্ত্বেও। বরং গলা খুলেই তাঁরা অনেকে এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।

এ কথা ঠিক যে, প্রধানমন্ত্রী আর একটু আটঘাট বেঁধে, প্রস্তুতি নিয়ে কাজটা করলে জনগণের কিছু সুবিধে হত। মোদীজি পুঁইশাক এনেছেন বটে, কিন্তু কুমড়ো আনতে ভুলেছেন। ভুলটা তেমন গুরুতর নয়, ইচ্ছে করলে উপেক্ষা করা যায়। আর যাদের নিয়ে ভারতবর্ষের জনগণের সিংহভাগ, তাদের টাকা এতটাই সাদা যে, রক্তাল্পতায় ভুগছে। তাদের কালো টাকা নিয়ে ভয়টা কী? আর যাদের প্রকৃতই কালো টাকা আছে, তাদের সেই টাকা কবেই সরেস জমিতে, দামি সোনার বিস্কুটে কিংবা শাঁসালো লগ্নিতে ছদ্মবেশ ধারণ করে শোভা পাচ্ছে। তাদেরই বা ভয়টা কী?

আর আমার মুশকিলও এখানেই। ভয়টা আসলে পাচ্ছে কে?


- - - - - - - - - Advertisement - - - - - - - - -

© Copyright@2024.ABP Network Private Limited. All rights reserved.